আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে। তদন্ত প্রতিবেদন যেকোনো মুহূর্তে দাখিল হতে পারে।
গতকাল রোববার এ বিষয়ে শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে গণমাধ্যম কর্মীদের তিনি একথা জানান। এদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আজ (রোববার) ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলার শুনানি হয়। প্রথম মামলাটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের। এ মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জন আসামী রয়েছেন যারা এই অপরাধের নির্দেশদাতা ছিলেন। এই মামলার ১৭ জন আসামী উপস্থিত ছিলেন। আমরা আদালতে এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে একটি রিপোর্ট দিয়েছি এবং দুই মাসের সময় চেয়েছি। আদালত আমাদের দুই মাসের সময় দিয়েছেন।
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, পরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুইটি মামলার শুনানি হয়। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার সম্পৃক্ততার বিষয়ে যে মামলাটি রয়েছে সেটির বিষয়ে আমরা আদালতকে জানিয়েছি। আমরা আমাদের তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হবে। তারপরও আমরা সত্যতার জন্য দুই মাসের সময় চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেছিলাম। আবেদন আদালত মঞ্জুর করেছেন। আগামী ২৪ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেছেন। কিন্তু আমরা আপনাদেরকে এটা জানাতে পারি যে কোন মুহূর্তে প্রতিবেদনটি দাখিল হয়ে যাবে। সেটা আগামী সপ্তাহেও হতে পারে, যে কোনো সময় হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের জন্য আমরা সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়েছি। বিভিন্ন ধরনের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ যেমন সিসিটিভি ফুটেজ, ক্যামেরা কিংবা ড্রোন ফুটেজ আমরা সংগ্রহ করেছি।
তদন্তের একেবারে শেষপর্যায়ে এসে মোটামুটি এটা বোঝা যাচ্ছে যে এসব অপরাধ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে, সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির মাধ্যমে হাসিনা তার মন্ত্রী পরিষদ, পুলিশ বাহিনীসহ সকলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তারা এই পরিকল্পনা সাজানো থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কাজ করেছে।
তিনি আরও বলেন, তৃতীয় যে মামলাটির শুনানি হয় সেটি হলো গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ক্রসফায়ার নিয়ে। এই মামলাটি আমরা ১১ জনের বিরুদ্ধে শুরু করেছিলাম। মামলায় মাত্র একজন গ্রেপ্তার আছেন তিনি হলেন সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান। শতশত গুমের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে কয়েকটি অভিযোগের তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তারপরও আমরা আদালতের কাছে তিন মাস সময় চেয়েছিলাম আদালত সেটি মঞ্জুর করেছেন। এ সময়ের মধ্যে গুমের অভিযোগগুলোর বিষয়ে তদন্ত-প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
এদিকে আদালতে গতকাল আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান খানকে হাতকড়া পরিয়ে তোলার সময় ওই নেতা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আসলে এ বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারে না। আদালতে আসামীকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে তোলা হবে কি না সেটা জেল অথরিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আসামীকে যদি কন্ট্রোল করতে না পারা যায় এবং তার পক্ষ থেকে যদি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে তাহলে তাকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বা আরও জটিল কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করে তাকে আদালতে তুলতে পারে জেল কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আদালতকে জানিয়েছে বিশেষ করে হাসানুল হক, শাজাহান খান ও জিয়াউল হাসান তাদের নির্বংশ করার হুমকি দিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করেছে। এছাড়া এদের মধ্যে একজন তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হেলমেট ছুড়ে মেরেছে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা ঝুঁকি মনে করে তাদের হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আদালতে তুলেছে। তারা সেটা আদালতকে জানিয়েছে।
এদিন সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সাবেক ১২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টাসহ মোট ১৯ জনকে। তাদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে ছাত্রী-শিক্ষক ও নাগরিকদের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চে। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
ট্রাইব্যুনালে হাজির করা ১৯ আসামীর মধ্যে রয়েছে- আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, ফারুক খান, দীপু মনি, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, আমির হোসেন আমু, কামরুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী ও সালমান ফজলুর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত ও বিচার কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই তাদের আদালতে তোলা হয়। এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের আদালতে হাজির করা হলে পরবর্তী শুনানির জন্য গতকাল দিন ধার্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
শাজাহান খানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ
জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। এ সময় তিনি মেজাজ হারিয়ে মাথা থেকে হেলমেট ছুড়ে ফেলেন।
গতকাল রোববার সকালে পুলিশের প্রিজনভ্যান থেকে নামিয়ে ট্রাইব্যুনালের হাজতে নেওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালের হাজতে নেওয়ার সময় হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন শাজাহান খান। মাথায় থাকা হেলমেট খুলে মাটিতে ফেলে দেন তিনি। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে শান্ত করার পাশাপাশি হেলমেটটি পুনরায় তার মাথায় পরিয়ে দেন।