জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছত্রীসেনা মোতায়েন করতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বোম্বিং করা হবে।

গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১-এ শেখ হাসিনা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও শোনা হয়। অডিওতে শেখ হাসিনাকে এই পরিকল্পনার কথা বলতে শোনা গেছে। অপরদিকে তাপসের সাথে কথোপকথনের এক অডিওতে শোনা যায় শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি বললাম একটা জিনিস পোড়াতে, ওরা পুড়িয়ে দিলো...’

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় তিন আসামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দেন তানভীর হাসান জোহা, যিনি এই মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের একজন প্রসিকিউটর।

জবানবন্দীর শেষ পর্যায়ে তানভীর হাসান পাঁচটি অডিও ট্রাইবুনালকে দেন, যার মধ্যে চারটি অডিও চালানো হয়। দুটি অডিওতে শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর কথোপকথন অন্তর্ভুক্ত ছিল। ট্রাইবুনালের গতকালের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

অডিওতে কথোপকথনের কিছু অংশ

হাসানুল হক ইনু: আমি মনে করি যে আপনার পদক্ষেপটা সঠিকই হয়েছে। এখন পর্যন্ত যা রিপোর্ট বাংলাদেশে পাচ্ছি আর কি। খালি ঢাকাতে আপনার রামপুরার দিকে এবং শনির আখড়াতে...।

শেখ হাসিনা: না, রামপুরা ক্লিয়ার। শনির আখড়ায় একটু ঝামেলা এখনো আছে।

ইনু: শনির আখড়ায় কিছু মোল্লারাই...।

শেখ হাসিনা: খালি মোল্লা না, সেখানে অনেক মাদরাসা। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মাইকিং করতে বলেছি। নারায়ণগঞ্জে ঢুকতে দিচ্ছে না আর্মিকে। আমরা ছত্রীসেনা নামাচ্ছি।

ইনু: ওহ, আচ্ছা।

শেখ হাসিনা: আমি বলছি, ক্যাজুয়ালটির দরকার নাই। ওরা ব্যারিকেড দিয়ে আছে তো, ঠিক আছে, আকাশ থেকে নামবে। কারণ, দুই পাশ দিয়ে ধরবে... ম্যাসেজটা দিয়ে দিতে পারেন।

ইনু: আচ্ছা।

শেখ হাসিনা: ছত্রীসেনা পাঠানো হচ্ছে। ঠিক আছে, হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে। হেলিকপ্টার যাক, ওপর দিয়ে মারবে।

ইনু: আচ্ছা, ওপর দিয়ে সাউন্ড বোম যাবে আর কি।

হাসিনা: হুম।

ট্রাইব্যুনালে হাসিনা-তাপসের অডিও

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের সময় শেখ হাসিনা নিজেই আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘আমি বললাম একটা জিনিস পোড়াতে, ওরা পুড়িয়ে দিলো...।’

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ ফজলে নূর তাপসের টেলিফোন আলাপে হাসিনা তাপসকে জানান, আন্দোলনের সময় বিভিন্ন স্থাপনায় আগুনের নির্দেশও তিনিই দিয়েছিলেন! এর আগে এই টেলিফোন আলাপেই শেখ হাসিনা লিথাল উইপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে প্রকাশ পায়।

ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও তাপসের আলাপে শোনা যায়, তাপস বলছেন, জ্বি আপনি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ইয়ে করেন। তখন শেখ হাসিনা বলেন, সব জায়গায় আগুন, বিআরটি, বিটিআরসি বন্ধ করে দিয়েছে, পোড়াইয়া দিছে, বিটিভি পোড়াইয়া দিছে, এখন তো ইন্টারনেট বন্ধ, সব পোড়াইয়া দিছে, এখন চলবে কীভাবে! তাপস বলেন, জ্বি, এটা ভালো হইছে, জ্বি। শেখ হাসিনা বলেন, না.. পোড়াইয়া দিছে, মেশিনপত্র সব পুড়ে গেছে। আমি বলছি যা যা পোড়াতে... ও আমাদের সেতু ভবন পোড়াইছে। তাপস বলেন, জি, ওরা রাতে মনে হয় আরো ব্যাপক আক্রমণ করবে। শেখ হাসিনা বলেন, হ্যাঁ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেটা পোড়াইছে..।

জবানবন্দীতে তানভীর হাসান বলেন, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার ফোনালাপের ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল নম্বরের কল রেকর্ড (সিডিআর) এনটিএমসি থেকে জব্দ করা হয়। জুলাই আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী লেথাল উইপন ব্যবহার করে সরাসরি গুলীর নির্দেশ দিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয় করে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বোম্বিং করার কথা বলেছিলেন এবং পরিকল্পিতভাবে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছিলে।

এরপর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা ফোন আলাপের যেসব অডিও শুনেছেন, তাতে শেখ হাসিনা নিজেই আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমি বললাম একটা জিনিস পোড়াতে, (যা যা পোড়াতে..) ওরা পুড়িয়ে দিলো সেতু ভবন।’ তার মানে আগুন দেওয়ার নির্দেশ উনি দিয়েছেন। কিন্তু উনার কাক্সিক্ষত জিনিস না পুড়িয়ে অন্য স্থাপনা পোড়ানো হয়েছে।

মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য দুই আসামী হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী পেশ করেন।

এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)।

সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর চলতি বছরের ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

একই সঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন আদালত। এরপর ৩ আগস্ট থেকে মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে এখনো চলছে।