মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানি আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সেদিন এ মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানি কাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করেন। এর আগে সকাল ১০টার কয়েক মিনিট আগে মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল।
এ টি এম আজহারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানিয়ে বলেন, আমরা আজ (মঙ্গলবার) মামলায় ৯০ শতাংশ শুনানি করেছি। এরপর আগামী দিনে পরবর্তী ১০ শতাংশ শুনানি করবো। আপিল শুনানিতে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সব বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেন আপিল বিভাগে।
তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে ‘সংক্ষিপ্ত রায়ের আলোকে’। সে সময় আমরা আদালতে এর বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু সেটি শোনা হয়নি। আদালতে মরহুম সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন তখন বলেছিলেন-আমার প্র্যাকটিস জীবনের ৫৩ বছরে এমনটি দেখিনি। তার কথাও কর্ণপাত করা হয়নি।
শিশির মনির আদালতে আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করা হয়েছে ডমেস্টিক আইনে। সেখানে আন্তর্জাতিক আইন মানা হয়নি।
উপমহাদেশে এমন নজির নেই উল্লেখ করে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর এটা করা হয়। কারণ ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ছিলো দেশে। নির্বাচনের আগে ফাঁসি দিতে হবে তাই এটা করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, রিভিউ যখন খারিজ হয়, কেন খারিজ হলো সেটার কারণ লিখে ফাঁসি দিতে হতো। কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায়ে লেখা ছিলো না কী কারণে রিভিউ খারিজ করা হলো। সংক্ষিপ্ত রায় সাধারণত আসামিকে কারাগার থেকে বের করার সময় করা হয়।
আপিল বিভাগের এ টি এম আজহারুল ইসলামের মামলার শুনানি শুরু হয় সকাল ১০টার কিছু আগে। এরপর বেলা ১১টা পর্যন্ত শুনানি শেষে আদালত বিরতিতে যান। বিরতির পর দুপুর পৌনে ১২টায় আবার শুনানি শুরু হয়ে টানা দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মামলার শুনানিতে সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেলসহ জামায়াতের কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতা ও বিপুল সংখ্যক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এরপর দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানি শেষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
আদালত বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে আবারো শুনানি অনুষ্ঠিত হবে এবং ওইদিন আপিল বিভাগের কার্যতালিকার শীর্ষে থাকবে মামলাটি।
আদালতে আপিলের শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শিশির মনির। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট রায়হান উদ্দিন ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী এডভোকেট এস.এম শাহজাহান, এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলালসহ কয়েকশত আইনজীবী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরশাদুর রউফ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলসহ আরও অনেকে। আদালতে প্রথম সাতজন বিচারপতি শুনানি করেন। এ সময় এজলাস কক্ষ আইনজীবীতে পূর্ণ ছিল।
পরে ব্রিফিংএ শিশির মনির বলেন, আমরা আদালকে বলেছি যে, রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে আগে ফাসিঁ কার্যকর করা হয়েছে। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। তাকে ফাসিঁ দেয়ার জন্য যে রায় দেয়া হয়েছিল তা হলো রাজনৈতিক বিবেচনায় তাকে টার্গেট করা হয়েছে। কারণ হলো, একটি ঘটনায় তাকে ফাসিঁ দেয়া হয়েছে, তাতে স্বাক্ষীরা বলেছেন, তারা ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূর থেকে দেখেছেন। আর্ন্তজাতিক আইনের প্রযোজ্যতা হবে না মর্মে আপিল বিভাগ আগে রায় দিয়েছেন। আর্ন্তজাতিক আইনের প্রযোজ্যতা ছাড়া এই ট্রাইব্যুনালে বিচার করা সম্ভব নয়। আমি আশা করবো আপিল বিভাগ আর্ন্তজাতিক আইনের প্রযোজ্যতার বিষয়টি পজেটিভভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন একই সাথে আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদন্ড থেকে খালাস প্রদান করবেন। এর আগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রসেস ভারতীয় উপমহাদেশের ৪শ বছরের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। অতীতের রায় ও মৃতুদন্ড কার্যকরের সব বিষয়গুলো আদালতের রায়ে থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তিনি আরো বলেন, বায়োনিক আই দ্বারা ৬ কিলোমিটার দূর থেকে দেখা সম্ভব, বাস্তব চোখ দ্বারা তা দেখা সম্ভব নয় এবং কাউকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এ ধরনের সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে মামলা বিচারের ক্ষেত্রে। আদালতে স্কাইপি কেলেঙ্কারীর বিষয়ে বলেছি, স্কাইপ কেলেঙ্কারির সকল ইমেইল ও অডিও এবং পত্রিকার রিপোর্ট বিজ্ঞ আদালতে উপস্থিত করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল বলেছে, এগুলো আদালতের দেখার বিষয় নয়। এগুলো সবই আমাদের কাছে রক্ষিত আছে। আপিল বিভাগ দেখতে চাইলে আমরা দেখাবো। আর সুখরঞ্জন বালিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে আইনজীবীর সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে পরে ভারতে পাওয়া যায়, সেখানে সাজা দেয়া হয় পরে বাংলাদেশে এসে বর্তমানে তিনি বাসায় আছেন। আমরা বলেছি, এগুলো প্রমাণ করে ট্রাইব্যুনালে যা হয়েছে তা সবকিছু হয়েছে অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও কতিপর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সাজা দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যই এসমস্ত কাজ করা হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, আপিলের রায়ে বিচারপতি জিনাত আরা বলেছেন, যে ধরনের সাক্ষী দেয়া হয়েছে এ ধরনের সাক্ষীকে মোটেও বিশ্বাস করার কোন সুযোগ নেই। তিন কিলোমিটার দূরে থেকে যিনি দেখতে পায় তাকে আমি কিভাবে বিশ্বাস করি। যিনি ছয় কিলোমিটার দূরে থেকে দেখতে পায় তাকে আমি কিভাবে বিশ্বাস করি। যিনি নিজের সন্তানের নাম বলতে পারেন না, সন্তান কয়জন বলতে পারেন না, কিন্তু আসামীর নাম বলেন, তাকে কিভাবে আমি বিশ্বাস করব। একথা বলে তিনি এদের স্বাক্ষ্যগত কোন মূল্য নেই, তাদের বিশ্বাস করে কাউকেই সাজা দেয়া যাবে না এবং তিনি এটিএম আজহারুল ইসলামকে ২ নাম্বার ও ৩ নাম্বার চার্জ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ৯ ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে ২ নম্বর, ৩ নম্বর ও ৪ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অমানবিক অপরাধের দায়ে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে শুনানির পর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। আপিল বিভাগের রায়ে ২, ৩, ৪ (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে) ও ৬ নম্বর অভিযোগের দণ্ড বহাল রাখা হয়। আর ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। ওইদিন আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মরহুম খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন (প্রয়াত) অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। ওই রায়ের রিভিউ চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে সংশ্লিষ্ট আবেদন করেছিলেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। ২৩ পৃষ্ঠার পুনর্বিবেচনার এ আবেদনে মোট ১৪টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।
পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে এটিএম আজহারুল ইসলামকে আপিলের অনুমতি দেন।