ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ের কার্যাদেশে অনিয়ম, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ওবায়দুল কাদেরসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রোববার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এর সহকারী পরিচালক মো: তানজিল হাসান বাদী হয়ে এই মামলাটি (নং-১৬) দায়ের করেন। মামলায় টোল আদায়ে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডকে কাজ দিয়ে সরকারের প্রায় ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগ আনা হয়েছে। সাবেক ৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও মামলায় আসামী হয়েছেন।
এর আগে কমিশন ইতোমধ্যে মামলার অনুমোদন দিয়েছে বলে গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের জানান সংস্থার সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) তানজির আহমেদ। অন্য আসামিরা হলেন, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী (অর্থ ও পরিকল্পনা) এম এ মান্নান, সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফারুক জলিল, সাবেক উপসচিব মোহাম্মদ শফিকুল করিম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ফিরোজ ইকবাল ও ইবনে আলম হাসান, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আফতাব হোসেন খান ও আব্দুস সালাম, সিএনএস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনীর উজ জামান চৌধুরী, পরিচালক সেলিনা চৌধুরী ও ইকরাম ইকবাল।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের বরাতে দুদক বলছে, ২০১৬ সালে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়কারী হিসেবে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) লিমিটেডকে নিয়োগ দিতে আগের দরপত্র ‘ইচ্ছাকৃতভাবে বাতিল’ করে একক উৎসভিত্তিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ রেখে কেবল সিএনএস লিমিটেডের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য টোল আদায়ের চুক্তি করা হয়। এতে সার্ভিস চার্জের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ ঠিক না করে হার বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। এই হার ছিল আদায় করা টোলের ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ (ভ্যাট ও আয়কর ব্যতীত)।
দুদক বলছে, এ চুক্তির আওতায় সিএনএস লিমিটেড মোট ৪৮৯ কোটি ৪৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বিল গ্রহণ করে। অন্যদিকে ২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত একই সেতুর টোল আদায়ের জন্য এমবিইএল-এটিটি মাত্র ১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় কাজ করে। পরবর্তীতে ২০২২-২০২৫ মেয়াদে ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে ৬৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় (ভ্যাট ও আয়করসহ) কার্যাদেশ দেওয়া হয়, যা পাঁচ বছরে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় প্রায় ১১২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, সিএনএস লিমিটেড কথিত ‘নতুন প্রযুক্তি স্থাপন ও অবকাঠামো ব্যয়’ বাবদ আরও ৬৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দাবি করে।
তুলনামূলক বিশ্লেষণে দুদক মনে করছে, সিএনএস লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেওয়ার ফলে সরকারের মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯০ টাকা।
দুদক বলছে, সিএনএস লিমিটেডের পরিচালক, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে এ অনিয়ম করেছেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডে একক উৎসভিত্তিক দরপত্রে নিয়োগ দিতে পূর্বের টেন্ডার বাতিল করা হয়। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই শুধু সিএনএস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে পাঁচ বছরের জন্য সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা হয় মোট আদায়কৃত টোলের ১৭.৭৫ শতাংশ হারে। এর ফলে সিএনএস লিমিটেড মোট ৪৮৯ কোটি ৪৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা বিল গ্রহণ করে, যা একই মেয়াদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। সেতুতে ২০১০-১৫ এই পাঁচ বছরে MBEL-ATT এই দুটি কোম্পানিকে জয়েন্ট ভেঞার কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে টোল আদায়ে ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯১২ টাকায় নিয়োগ করা হয়। অথচ মেঘনা-গোমতী সেতুতে ২০২২-২৫ এই তিন বছরে ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে ভ্যাট ও আইটিসহ ৬৭ কোটি ৫৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৬৬ টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়, যা পাঁচ বছরে রূপান্তর করলে হয় ১১২ কোটি ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ১১০ টাকা। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই নিয়োগের ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৩০৯ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯০ টাকা।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ও সিএনএস লিমিটেডের পরিচালকরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও আত্মসাতের মাধ্যমে নিজেদের বা অন্যকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় মামলাটি দায়ের করেন।