জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে জেরাকালে শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, আবু সাঈদ হত্যার ফুটেজ এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকদের অনেকে হাসাহাসি শুরু করেন। জবাবে সাক্ষী এ কে এম মঈনুল হক বলেন, এটি সত্য নয়।

তৃতীয় দিনে আজ বুধবার (৬ আগস্ট) ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে সাক্ষী দেওয়া দুজন হলেন— রংপুরের এনটিভির সাংবাদিক এ কে এম মঈনুল হক ও রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিনা মুরমু। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে হামলার সময় প্রত্যক্ষ্যদর্শী তারা। এ নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচজন সাক্ষী দিলেন এ মামলায়।

রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী তাদের জেরা করেন। পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৭ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত।

বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে আজ এ শুনানি হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

দুপরের পরে আজ পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে এ.কে.এম মঈনুল হক তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। আমি ইন্টারন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট হিসেবে রংপুরে কর্মরত আছি।’

‘২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর ২টার আগে থেকে আমি ও আমার সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট আসাদুজ্জামান আরমান রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে পার্কের মোড় এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর প্রেসক্লাব এলাকা থেকে একটি মিছিল নিয়ে আমরা যেখানে অবস্থান করছিলাম সেখানে আসে। মিছিলটি যখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে আসে সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সরকারি দলের সমর্থকরা বাধা দেয়। পুলিশের আশপাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দেখতে পাই।’

সাক্ষী তার জবানবন্দিতে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে একটি সমাবেশ করার চেষ্টা করে, দু’একজন কথা বলার চেষ্টা করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যেতে চায়। এ সময় পুলিশ এবং তাদের সাথে যারা ছিল তারা বাধা দেয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ লাঠি চার্জ শুরু করে। আন্দোলনকারীরা লাঠি চার্জ থেকে নিজেদের বাঁচাতে আত্মরক্ষার্থে স্লোগান দিয়ে জমায়েত ধরে রাখার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও শটগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন দুপুর ২টা পার হয়ে গেছে। এনটিভির দুপুর ২টার খবরও শুরু হয়ে গেছে। আমরা টিয়ারশেল, গুলিবর্ষণসহ সেখানকার ভীতিকর অবস্থার ভিডিও ফুটেজ সরাসরি এনটিভিতে প্রেরণ শুরু করি। সেই ভিডিও ফুটেজ দেখে এনটিভি কর্তৃপক্ষ আমাকে লাইভে সম্পৃক্ত হওয়ার নির্দেশ দেন। দুপুর আনুমানিক ২টা ১৩ মিনিটের দিকে আমার সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট আসাদুজ্জামান আরমানসহ আমি লাইভে যুক্ত হই।’

‘সেখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতি এনটিভির মাধ্যমে সারা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরি। দুপুর আনুমানিক ২টা ১৭ মিনিটের দিকে ১নং গেটের সামনে রোড ডিভাইডারের একটি ছোট কাটা অংশ দিয়ে এগিয়ে এসে একজন যুবক কালো টিশার্ট ও কালো প্যান্ট পরা, রাস্তার ডিভাইডারের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে।’

‘এ সময় তিনি দু’দিকে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজের দূরত্বে ১নং গেটের সামনে অবস্থানরত পুলিশ যারা আগে থেকে গুলি করছিলেন, তারা এই দু’দিকে দু’হাত প্রসারিত করা যুবককে উদ্দেশ্য করে গুলি করে। এই দৃশ্য তখন এনটিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছিল। পুলিশের গুলি এই যুবকের সামনের দিকে অর্থাৎ বুক ও পেটে বিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওই যুবক কয়েক পা পিছিয়ে যান এবং বসে পড়েন। বসে পড়ার সাথে সাথে তিনি আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তার দেহের ভারসাম্য রাখতে না পেরে রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়েন।’

‘এ সময় তার অন্য সহযোগী কয়েকজন যুবক তাকে তুলে নিয়ে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যান। এনটিভির লাইভে তাকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত ক্যামেরায় আসছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সম্প্রচার করা হয়। একই সাথে যখন ওই যুবককে গুলি করা হয় ঠিক সে সময় ক্যামেরা প্যান (ক্যামেরা ঘুরিয়ে) করে ১নং গেটের সামন থেকে যে পুলিশরা গুলি করছিল তাদেরকেও এনটিভির লাইভে দেখানো হয়। আর ওই মুহূর্তে ঘটনাটি একমাত্র এনটিভি লাইভ সম্প্রচার করে।’

‘এরপর আমরা আমাদের অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ ওই যুবককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানতে পারি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি, গুলিবিদ্ধ ওই যুবক রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং তার নাম আবু সাঈদ। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আমরা জানতে পারি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদ মৃত্যুবরণ করেছেন।’

‘উক্ত ভিডিও (Raw) ফুটেজের একটি কপি পিবিআই নিয়েছে। মূল ভিডিও (Raw) ফুটেজ আজকে আমি নিয়ে এসেছি। লাইভ সম্প্রচারের একটি কপি আমি বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি। সেই ফুটেজ দুটি একটি পেনড্রাইভে আছে। এই সেই Raw ফুটেজ এবং লাইভ সম্প্রচারের ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ (বস্তু প্রদর্শনী)। Raw ফুটেজ এবং লাইভ সম্প্রচারটি মাননীয় ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হলো। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই আমার জবানবন্দি।’

এ সময় আবু সাঈদ হত্যার ভিডিও ফুটেজ আদালতে প্রদর্শন করা হয়। এ ভিডিওটি আদালত নথিভুক্ত করেন।

জবানবন্দি শেষে শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন সাক্ষী মঈনুল হককে জেরা করে বলেন, এ ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আপনি গুলির দৃশ্য ও আসামির দৃশ্য এক সময়ে একসাথে ভিডিও করতে পারনেন না।

এ সময় আদালত বলেন, এ প্রশ্ন তো যুক্তিতর্কের সময় বলবেন এখন নয়।

পরে আইনজীবী বলেন, আবু সাঈদ হত্যায় করা ভিডিওটি ফুটেজটি এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকদের অনেকে হাসাহাসি শুরু করেন। জবাবে সাক্ষী এ কে এম মঈনুল হক বলেন, এটি সত্য নয়। এ পর্যায়ে আদালত সাক্ষ্য শেষ করে মামলা মুলতবি ঘোষণা করেন।