চৌগাছা (যশোর) সংবাদদাতা : ২০১৬ সাল ৪ আগস্ট গভীর রাত চারিদিকে সুনশান নিরবতা। রাস্তার পাশে কেবল ঝিঝি পোকারা ডাকছে করুণ সুরে। জোনাকিরা আলো জ্বালিয়ে জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। হঠাৎ রাতের নিরবতা ভেঙে পুলিশের গুলীর শব্দে জেগে ওঠে যশোরের চৌগাছা উপজেলার বুন্দলীতলা গ্রামের বাসিন্দারা। অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে বুক। কেননা প্রতিদিন পুলিশের গুলীতে সন্তান হারাচ্ছে পিতামাতা। আজ না জানি আবার কোন মায়ের বুক খালি হলো! গুলির পরপরই পুলিশের নাটক ধর ধর! এই গুলি করছে সবাই বসে পড়ো! সবাই সাবধান হও! কেউ আছেন? আমাদেরেক সাহায্য করেন...... ইত্যাদি বাক্যের চিল্লা পাল্লায় এগিয়ে আসেন বুন্দলীতলা গ্রামের বাসিন্দারা। আহারে এসে দেখে তাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের দুই সোনা মানিক শিবির নেতা রুহুল আমিন আর ইস্রাফিল ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে আর দুইজনের দুই হাটু দিয়ে রক্তের তীব্র স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিল নিথর দুটি দেহ কিন্তু কারো বুঝতে বাকি থাকেনা সবই পুলিশের পাতানো নাটক। গত ২৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে আগত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্তকারী টিমের সামনে এভাবেই সাক্ষ্য দেন রুহুল আমিন, ইস্রাফিল,এলাকাবাসী আর গণমাধ্যম কর্মিরা।
ঘটনার সুত্রপাত ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ সাংগঠনিক কাজ শেষ করে মটর সাইকেল যোগে নারায়ণপুর গ্রামের বাড়ি ফিরছিলেন চৌগাছা উপজেলা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ইস্রাফিল হোসেন ও সাহিত্য সংস্কৃতিক সম্পাদক রুহুল আমিন। পথিমধ্যে বুন্দলীতলা গ্রামের শেষ মাথা থেকে তাদেরকে আটক করেন চৌগাছা থানার এসআই মোখলেছুর রহমান ও এএসআই মাজেদুল হক। তাদের কাছে শিবিরের কাগজপত্র ও বইপুস্তক দেখে তেলেবেগুনে জলে ওঠেন তারা। সাথে সাথে থানাসহ পুলিশ সুপার কার্যালয় পর্যন্ত খবর হয়ে যায় দুই শিবির নেতা আটকের কথা। থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে হাজরাখানা যাত্রী ছাউনিতে নামিয়ে তাদেরকে নাকে মুখে মারপিটসহ বুট দিয়ে চটকিয়ে ও লাথি মেরে আহত করে তাদের দুজনকে। এরপর তাদের বাড়িতে ফোন করে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আসার জন্য বলে। এরপর তাদেরকে থানায় নিয়ে গেলে ওসি এম মসিউর রহমান, সেকেন্ড অফিসার আকিকুল ইসলাম ও এসআই মমিনুর রহমান ক্ষুধার্ত বাঘের মত হামলে পড়ে দুই তরুণের উপর। জিজ্ঞাসাবাদের নামে ওসি বেদম মারপিট করে তাদেরকে। এসময় সেকেন্ড অফিসার আকিক বার বার বলতে থাকেন স্যার এদের ব্রেন ওয়াশ করা কোন কথা বলবেনা, চলেন ক্রসফায়ার দিয়ে দিই। কিন্তু উপরের নির্দেশনা থাকায় সেদিনের মত তাদেরকে থানা গারদে রেখে দেওয়া হয়।
৪ আগস্ট ২০১৬, সকাল আটটা থানায় তথ্য সংগ্রহে যান তৎকালীন দৈনিক সংগ্রামের চৌগাছা সংবাদদাতা ও চৌগাছা প্রেসক্লাবের সহসভাপতি রহিদুল ইসলাম খান, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার এমএ রহিম ও দৈনিক স্পন্দন পত্রিকার বাবুল আক্তার। তারা থানা গারদে রুহুল আমিন ও ইস্রাফিলকে দেখে জিজ্ঞেস করেন তাদেরকে কখন আটক করেছে? তারা বলে রাতে। এরপর তারা সকালে নাস্তা করেছে কিনা জানতে চাইলে তারা না উত্তর দেই। এসময় সংবাদকর্মীরা তাদের জন্য হোটেল থেকে নাস্তা নিয়ে এসে তাদেরকে খেতে দেয়।
রুহুল আমিন আর ইস্রাফিল জানান ৪ আগস্ট বেলা ১২ টার দিকে সেকেন্ড অফিসার আকিক তাদেরকে নিয়ে যশোর জেলা পুলিশ সুপার আনিচুর রহমানের অফিসে যান। সেখানে গেলে আনিচুর রহমান অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলেন,শুয়োরের বাচ্চারা এখনও বেঁচে আছে? এখান থেকে নিয়ে যাও আজ রাতে ফাইনাল করে দিও। এরপর সেকেন্ড অফিসার আকিক দুইজনকে নিয়ে সন্ধ্যার পর ডিবি কার্যালয়ে যান। সেখানে ডিবির তৎকালীন ওসি ইমাউল হকও পুলিশ সুপার আনিচুর রহমানের মত গালিগালাজ করে বলেন, এখন নিয়ে যান গভীর রাতে ফাইনাল হবে।
তারা আরো জানান ৪ আগস্ট গভীর রাতে যশোর থেকে তাদেরকে নিয়ে চৌগাছার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে টালিখোলা নামক স্থানে পৌঁছে তাদের দুজনের চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর প্রায় ১৫ মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটা নির্জন স্থানে নামিয়ে তাদের দুজনকে দাঁড় করিয়ে দুইজনের দুই হাটুতে গুলি করে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে আমাদের চোখ খুলে দিয়ে ঐ গামছা দিয়ে হাটু বেঁধে ফেলে। পরে হাসপাতালে পৌঁছে সেখানে ওসি এম মশিউর রহমান, সেকেন্ড অফিসার আকিকুল ইসলাম,এসআই মমিনুর রহমান, মোখলেচুর রহমান, এএসআই মাজেদুল হক, এএসআই জামাল হোসেনসহ আরো অনেকে আমাদেরকে এমনভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন যে,এইমাত্র আমাদেরকে তারা দেখেছে অথচ ৩ আগস্ট রাত থেকে তারা আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
এপর্যায়ে তারা আমাদেরক দুটি মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেয় একটি অস্ত্র আইনে আর একটি পুলিশের ওপর হামলা মামলা। আদালত চিকিৎসার সুযোগ দিলে আমাদেরকে ঢাকা কাকরাইলের ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসা দেওয়া হয়। দীর্ঘ দেড় মাস চিকিৎসার পর ডাক্তার আমাদের একটি করে পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলে। মামলা দুটি চার্জশীট দাখিল করেন এসআই জামাল হোসেন। ভিকটিম ইস্রাফিল হোসেন জানান সেসময় এসআই জামাল তাদের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিতো পাঁচ লাখ টাকা না দিলে বাড়িঘর ভেঙে দিবে।
পরবর্তীতে আদালতে আইনি লড়াইয়ে আদালত অস্ত্র আইনে করা মামলাটি খারিজ করে দেয়। অন্য মামলাটি এখনও চলমান আছে।
ট্রাইবুনালের কাছে আরো সাক্ষ্য দেন নারায়ণপুর গ্রামের তুহিনুর রহমান, তৌহিদুর রহমান,চুটারহুদা গ্রামের আতিয়ার রহমান, বুন্দলীতলা গ্রামের রিংকু মিয়া,সাইফুল ইসলাম, বাটিকামারী গ্রামের আব্দুর রহিম, নারায়ণপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম, ওয়াজেদ আলী ও গণমাধ্যম কর্মীরাসহ প্রায় চল্লিশ জন মানুষ তদন্তটিমের কাছে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন আমরা এ ঘটনার ন্যায় বিচার চাই।