জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল ১১টায়, বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই রায় প্রদান করবে।

২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার গণবিক্ষোভে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত এবং ২৫ হাজারের মতো আহত হওয়ার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করে।

প্রসিকিউশনের পাঁচ অভিযোগ

তদন্ত ও শুনানি শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগগুলো হলো—

১. ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে উসকানির অভিযোগ

২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনের এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। পরে তার নির্দেশ–উৎসাহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিরস্ত্র ছাত্র–জনতার ওপর হামলা চালায়। এতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ২৫ হাজার আহত হয়।

২. প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ

হেলিকপ্টার, ড্রোন ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের দমন করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা—এমন অভিযোগ প্রসিকিউশনের। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন বলে দাবি করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনের অডিওও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

৩. রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা ও তথ্য গোপন

১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে—নির্দেশদাতাদের মধ্যে শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুন ছিলেন। পরে চারবার ময়নাতদন্ত পরিবর্তন এবং সহপাঠীদের আসামি করে পাল্টা মামলা করার বিষয়েও তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়।

৪. চানখাঁরপুলে আনাসসহ ছয়জনকে হত্যা

৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ চলাকালে চানখাঁরপুলে ছাত্রনেতা শাহরিয়ার খান আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রসিকিউশনের দাবি—সুপিরিয়র কমান্ড হিসেবে এই হত্যার নির্দেশ আসামিরাই দিয়েছিলেন।

৫. আশুলিয়ায় ছয় মরদেহ পোড়ানোর অভিযোগ

৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীকে হত্যা করে লাশ পোড়িয়ে ফেলার ঘটনা আড়াল করার অভিযোগ রয়েছে। নির্দেশদাতাদের তালিকায় শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্য, মামুন রাজসাক্ষী

মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দেন। দেশি–বিদেশি গণমাধ্যমের ভিডিও, অডিও ও নানা প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়।

সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হন এবং অন্য আসামিদের অপরাধ আদালতে বর্ণনা করেন।

সাক্ষীদের বয়ানে যা উঠে আসে

চোখ হারানো, পঙ্গু হওয়া, সন্তান হারানো—এ ধরনের বহু মানবিক বর্ণনা আদালতে তুলে ধরেন আহতরা, শহীদ পরিবারের সদস্যরা, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। রংপুর থেকে রাজধানী পর্যন্ত নানা স্থানে হত্যার বর্ণনা এবং চিকিৎসকদের প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপিত হয়।

রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি

প্রসিকিউশন

তাজুল ইসলাম সমাপনী বক্তব্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে নিউক্লিয়াস বা প্রাণভোমরা হিসেবে শেখ হাসিনাকে চিহ্নিত করে বলেন, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে এই 'প্রাণভোমরা'কে অবশ্যই বিচারিক প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় কমপক্ষে এক হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য যদি একবার করেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে শেখ হাসিনার এক হাজার ৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু একজন মানুষকে সেটা দেওয়া যায় না। যদি শেখ হাসিনাকে এই চরম দণ্ডাদেশটা দেওয়া হয়, তাহলেই ভুক্তভোগীদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে। এত মানুষ হত্যার পরও তার কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো মানুষ হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো কথাগুলো তিনি বারবার বলছেন। তার প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

আসামিপক্ষ

অপরদিকে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন, আসামিদের খালাস চেয়ে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সরকার চালাতে গেলে কিছু ভুলত্রুটি হয়, শেখ হাসিনাও কিছু ভুল করেছেন। তার বিরুদ্ধে যেসব চার্জ আনা হয়েছে, এগুলো সঠিক নয়। আমার অভিমত, সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই আমি আমার মক্কেল নির্দোষ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের খালাস প্রত্যাশা করি।

সবশেষে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি এবং শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের যদি শাস্তি নিশ্চিত না হয়, তাহলে ইতিহাসে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের মানুষ। এই আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের আরও অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি। কেননা গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের প্রতি অবিচার করা হবে।

রায় ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি

১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘লকডাউন’ কর্মসূচি দেওয়া হয়। ফলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

গত কয়েক দিনে দেশজুড়ে অর্ধশত গাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বিএনপি–জামায়াত ও এনসিপি পাল্টা প্রতিরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নেওয়া হয়েছে বহুস্তরের নিরাপত্তা।

ট্রাইব্যুনালের পুনর্গঠন ও মামলার সূত্রপাত

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর বিধান অনুযায়ী, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে অনেকের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির রায় কার্যকর করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আরও বেশ কয়েকজনের বিচার চলছিল।

তবে ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের আগের বিচারককে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমনপীড়নকে 'গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী' অপরাধ বিবেচনা করে একই ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ১৪ অক্টোবর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করা হয়।

২০২৪ সালের ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক ও পলাতক শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৫৬টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন কার্যালয়ে জমা পড়ে। এর মধ্যে ৫৪টি অভিযোগেই প্রধান আসামি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন।

প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য শুরুতে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেপ্তার করে ১৮ নভেম্বর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির এবং তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেন। প্রথমে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলে পরে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে প্রসিকিউশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রসিকিউশন একাধিক মামলা করে। এর মধ্যে ১ জুন প্রথম মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।