# ট্রাইব্যুনালে গুলী করে হত্যার দৃশ্য প্রদর্শন

# গুলীর নির্দেশ দেয়া শেখ হাসিনার অডিও প্রদর্শন

নাম হৃদয়। বয়স ২০ বছর। অসচ্ছল পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। কাঁধে সংসারের বোঝা থাকায় লেখাপড়ার পাশাপাশি চালাতেন রিকশা চালিয়ে। কোনোভাবে চলছিল পরিবার; কিন্তু অদম্য এই মেধাবীকে বাঁচতে দিল না ‘পাষণ্ড’ পুলিশ। খুব কাছে থেকে গুলী চালিয়ে হৃদয়ের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়। এমনকি ছেলের লাশটাও খুঁজে পাননি মা। রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাতের আঁধারে ফেলে দেওয়া হয় তুরাগ নদের কড্ডা ব্রিজের নিচে।

হৃদয়কে সেদিনের গুলী করার দৃশ্যটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরা হয়। মর্মান্তিক সেই চিত্র দেখাতেই নীরবতা নেমে আসে ট্রাইব্যুনালের এজলাসে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্কের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল সোমবার। এ দিন বেলা ১১টা থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আজ মঙ্গলবার আবার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন তিনি।

প্রথম দিনের মতো জুলাই-আগস্টের বিভিন্ন পটভূমি তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। একপর্যায়ে গত বছরের ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে চালানো পুলিশের নৃশংসতা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয় ট্রাইব্যুনালে।

ভিডিওতে দেখা যায়, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর কোনাবাড়ী থানা এলাকায় বিজয় মিছিল বের করেন ছাত্র-জনতা। আর এ মিছিলে অংশ নেন হৃদয়। মুহূর্তেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলী ছুড়তে থাকে পুলিশ। জীবন বাঁচাতে সবাই আশ্রয় নেন নিরাপদ স্থানে। কিন্তু হৃদয়কে ধরে আনেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ঘিরে রাখা হয় তাকে। বড় লাঠি নিয়ে একজন আঘাত করতে এগিয়ে আসতেই আরেকজন এই কলেজছাত্রকে চড় মারেন। হঠাৎ কিছু বুঝে না উঠতেই হৃদয়কে পেছন থেকে গুলী করেন কনস্টেবল আকরাম। আর এতেই প্রাণ হারান তিনি।

এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালকে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, কলেজছাত্র হৃদয়ের লাশটি রাতের আঁধারে গাজীপুরের কড্ডা নদীতে ফেলে দেয় পুলিশ। শহীদ হৃদয়কে কাছ থেকে গুলী করেন কোনাবাড়ী থানার কনস্টেবল আকরাম। এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন এই কনস্টেবল।

তিনি বলেন, শহীদ হৃদয়ের লাশের সন্ধানে কড্ডা নদীতে ডুবুরি নামিয়ে খোঁজা হয়েছিল। কিন্তু নদীটি প্রচণ্ড খরস্রোতা হওয়ায় লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে লাশ না পেলেও হৃদয়কে গুলী করা পুলিশ কনস্টেবল আকরাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি সব বর্ণনা তদন্ত সংস্থার কাছে তুলে ধরেছেন বলেও জানান চিফ প্রসিকিউটর।

হৃদয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামে। তার বাবার নাম লাল মিয়া। হৃদয় হেমনগর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতেন।

‘এবার আর কোনো কথা নাই, শুরুতেই দিবা’

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলী চালানোর নির্দেশনা সংবলিত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে তিনি কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না রেখে এক কর্মকর্তাকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলী করার নির্দেশন দেন।

ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আরও একজন।

শুরুতে তাজুল ইসলাম জুলাই-আগস্ট আন্দোলন নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্যচিত্র ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করেন। ওই ভিডিওতে শেখ হাসিনার শাসনামলে আন্দোলন দমন অভিযান এবং আওয়ামী লীগের ভেতরে সৃষ্ট অস্থিরতার চিত্র তুলে ধরা হয়। এরপর দেখানো হয় শেখ হাসিনার এক ফোনালাপের উল্লেখ থাকা অংশটি, যেখানে ছাত্র-জনতার জমায়েত দমন নিয়ে নির্দেশনা দেন তিনি।

অডিওতে কল ধরার সঙ্গে সঙ্গেই অপর প্রান্ত থেকে সালাম দেওয়া হয় ‘স্যার’ সম্বোধনে। শেখ হাসিনাকে তখন বলতে শোনা যায়, ‘ওরা কিন্তু জায়গায় জায়গায় এখন জমায়েত হতে শুরু করেছে। মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং বিভিন্ন জায়গায়। শুরুতেই কিন্তু ইয়ে.....করতে হবে, একদম শুরুতেই। ধাওয়া দিলে এরা গলিতে গলিতে থাকবে। এবার আর কোনো কথা নাই। এবার শুরুতেই দিবা।’

এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালকে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তি হলেন কর্নেল রাজিব। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে নেই। গত বছরের ২৯ জুলাই ফোনের মাধ্যমে রাজিবকে এ নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার শেষ কথা হচ্ছে- এবার আর কোনো কথা নাই। এবার শুরুতেই দিবা। মানে আসামাত্রই গুলী করা হবে। এটাই নির্দেশনা ছিল।

রোববার এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়। বেলা পৌনে ১২টা থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের ইতিহাস তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। একইসঙ্গে গুম-খুনসহ নারকীয় সব ঘটনার বর্ণনা দেন। আর এসব বিবরণ এ মামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম।