আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। যিনি তার মাকেও মিথ্যা মামলা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন! এছাড়া আসামীর সঙ্গে গোপন বৈঠক করে কয়েক কোটি টাকা ঘুস নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া দেশে ওয়াজ-মাহফিল বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে বরেণ্য ১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে কথিত ‘গণকমিশন’ গঠন করে দুদকে অভিযোগ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তার বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। সেই তুরিন আফরোজকে অবশেষে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর উত্তরায় আব্দুল জব্বার নামে এক শিক্ষার্থীকে হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার রাতে গ্রেফতারের পর গতকাল মঙ্গলবার তাকে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এসময় তুরিন আফরোজের পক্ষে আইনজীবী উপস্থিত থাকলেও তিনি নিজেই আদালতে কথা বলার নাম করে বিভ্রান্তি ছড়ান বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

জানা েেগছ, এদিন দুপুর ১টার দিকে তুরিন আফরোজকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এরপর ২টা ৩০ মিনিটে তাকে আদালতে হাজির করার উদ্দেশ্যে হাজতখানা থেকে হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হাতকড়া পরানো হয়। ২টা ৪০ মিনিটে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। কিছুক্ষণ পর বিচারক আসেন। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আব্দুল জব্বার নামে এক শিক্ষার্থীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় মামলার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত কর্মকর্তা সুমন মিয়া আসামীর ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর বলেন, ‘তুরিন আফরোজ বাংলাদেশে আলোচিত ও ঘৃণিত একজন মানুষ। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে তাকে তুমুল বক্তব্য রাখতে আমরা দেখেছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েম করতে যারা সহযোগির ভূমিকা এবং সুপ্রিম কোর্টকে হাসিনার কলোনিতে পরিণত করার জন্য যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অন্যতম তুরিন।’

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে একটা ন্যক্করজনক ঘটনা আমরা দেখেছি। সেখানে তিনি আসামীদের পক্ষে সুবিধা দেওয়ার জন্য টাকা গ্রহণ করেন। যার কারণে তাকে পাবলিক প্রসিকিউটর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের আইন সমাজের ওপর সাধারণ মানুষের যে আস্থা, সেটি নষ্ট করেছেন তুরিন আফরোজ। তার বিরুদ্ধে নীলফামারীর জলঢাকায়ও মামলা আছে। ৫ আগস্টের পর কিছু মানুষ পুনরায় দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। যে আসামীদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি, তাদের মধ্যে তুরিন আফরোজ রয়েছেন। এদিন তুরিন আফরোজের পক্ষে শুনানি করতে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে উপস্থিত হন। তবে তুরিন আফরোজ জানান, তার আইনজীবী আছে। তখন বিচারক জানতে চান, কে আপনার আইনজীবী। তুরিন আফরোজ বলেন, ‘সাইফুল করিম।’ তবে তখন তাকে খুঁজে পাননি তুরিন আফরোজ। তখন তুরিন আফরোজ বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি আপনার অনুমতি নিয়ে কথা বলতে চাই। আদালত তাকে অনুমতি দেন। তখন বিচারককে উদ্দেশ করে তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আমি দুই, তিন, পাঁচ মিনিট, কতটুকু সময়ে শেষ করবো বললে ভালো হয়। বিচারক বলেন, বলেন আপনি।’ তখন তুরিন আফরোজ বলেন, ‘৪ আগস্ট আমার বিরুদ্ধে নীলফামারীতে মামলা। পরদিন ৫ আগস্ট ঢাকায় মামলা।’ তখন আদালত বলেন, ‘ঢাকায় মামলা হয়েছে ২৭ মার্চ। ঘটনা ৫ আগস্টের। নীলফামারীর তথ্য এখানে নেই।’ তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আচ্ছা, যাই হোক।’ আমার লার্নেড ফ্রেন্ড (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) সাংঘর্ষিক কথা বলেছেন। নীলফামারীতে ৪ আগস্ট এবং ঢাকায় ৫ আগস্টের ঘটনায় মামলা। মামলাগুলো ফেব্রিকেটেড। ৫ আগস্টের আগে পুরো সময় কোথায় ছিলাম সব ডকুমেন্ট দিতে পারবো। এসময় আমার টিউমারের অপারেশন হয়।’ তুরিন আফরোজ বলেন, ‘গত চার বছর আমি মিডিয়াতে কিছু বলিনি, কিছু লিখিনি। বলা হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সাপোর্ট করেছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সাপোর্ট করলাম- আবার তার আমলেই চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ৬ বছর ধরে চাকরি থেকে বঞ্চিত। বুঝলাম না আমি কোন পক্ষের লোক।’ তিনি বলেন, ‘আমি আইনের প্রতি আস্থাশীল। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না। তদন্ত কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে। আপনি ২০ দিন দিলেও দিয়ে দেন। পরে আদালত তার চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রসিকিউটর হিসেবে ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা পরিচালনা করেন এই আইনজীবী। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রভাবশালী আসামী জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি মেজর (অব.) ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগ ছিল তুরিনের বিরুদ্ধে। এরপরই ট্রাইব্যুনাল থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে অনৈতিকভাবে আসামীর সঙ্গে গোপনে বৈঠক করার অভিযোগ তদন্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনও করা হয়।

যে তথ্য পাওয়া গেছে মোবাইল-ল্যাপটপে: উত্তরার বাসা থেকে গ্রেফতারের সময় তুরিন আফরোজের ল্যাপটপ ও মোবাইল তল্লাশি করে সরকারবিরোধী পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম জানান, তুরিন আফরোজের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে তার ব্যবহৃত মোবাইল ও ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো চেক করে দেখা গেছে তার ফেসবুকে অনেক সরকারবিরোধী প্রচারণা রয়েছে। সরকারবিরোধী প্রচারণার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান মহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে আব্দুল জব্বার নামের এক ছাত্রকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলীবিদ্ধ করার অভিযোগে দায়ের করা মামলার ৩০ নম্বর আসামী তিনি।

বরেণ্য ১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ: ইসলামপন্থী রাজনীতিতে অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের কাল্পনিক অভিযোগ এনে ১১৬ ধর্মীয় বক্তার একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দিয়েছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত ‘গণকমিশন’। দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য ওয়াজ-নসিহত বন্ধ করার লক্ষ্যে ইসলামী ওয়ায়েজীন বা বক্তাদেরকে টার্গেট করেই এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের নামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে পতিত সরকারের দালাল হিসাবে চিহ্নিত কিছু আলেমকে এই তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়। গণকমিশনের নামে বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে দুদকে বরেণ্য আলেমদের বিরুদ্ধে নালিশের ঘটনায় বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি ও ইসলামের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তের বহি:প্রকাশ বলে মনে করছেন অনেকে। এতে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়, এই অপতৎপরতা বন্ধ না হলে কঠোর আন্দোলনে জবাব দেওয়া হবে। ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার আলেমদের কোণঠাসা করতে এবং ওয়াজ-নসিহত বন্ধ করতে অনেক দিন থেকেই তৎপর। ভারতের হিন্দুত্ববাদী চরম সাম্প্রদায়িক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সরকারি তাণ্ডবের পর বাংলাদেশের প্রতিবাদী আলেমদের গ্রেফতার শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে গ্রেফতার হওয়া অনেক আলেম ও ইসলামী বক্তাকে কারাগারে আটক রাখা হয়। এরমধ্যেই তথাকথিত গণকমিশন অপতৎপরতা চালিয়ে আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তালিকা দেয়া হয়। ২০২২ সালের ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার হাতে এই তালিকা তুলে দেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণকমিশনের চেয়ারম্যান ও বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (বর্তমানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দী)। সঙ্গে ছিলেন সংগঠনটির সদস্যসচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। এতে এক হাজার মাদরাসা ও ১১৬ জন ইসলামী বক্তা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়।

মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন : রাজধানীর উত্তরার রেসিডেন্সিয়াল মডেল টাউনের ১১ নম্বর সড়কের ৩ সেক্টরের ১৫ নম্বর প্লটের পাঁচতলা বাড়িতে ২০০২ সাল থেকে বসবাস করে আসছিলেন তুরিন আফরোজের মা শামসুন্নাহার বেগম এবং তুরিনের ভাই শিশির আহমেদ শাহনেওয়াজ। তবে নিজের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মা ও ভাইকে ওই বাড়ি থেকে ২০১৭ সালে বের করে দেন তুরিন আফরোজ। পরে ওই বাড়ির ভোগদখল ও মালিকানা দাবি করে শাহনেওয়াজ ও তুরিন আফরোজ ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দুটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর দুই পক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে ওই বাড়ি ভোগদখলের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা জারি করেন আদালত। সম্প্রতি সেই মামলার রায় নিজেদের পক্ষে পেয়েছেন শামসুন্নাহার বেগম এবং শিশির আহমেদ। বিচারিক আদালতের মামলার আরজিতে তুরিন আফরোজ দাবি করেছিলেন, তার মা শামসুন্নাহার ১৯৯১ সালে ক্রয়সূত্রে উত্তরার সম্পত্তির মালিক হন। পরের বছর ১৯৯২ সালে শামসুন্নাহার তার স্বামী তসলিম উদ্দিনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিযুক্ত করেন। পরে ১৯৯৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তসলিম উদ্দিন ওই সম্পত্তি মেয়ে তুরিন আফরোজকে হেবা (দানপত্র) করে দেন। তবে শামসুন্নাহার ও তার ছেলে শাহনেওয়াজ আদালতে লিখিত জবাব দিয়ে বলেছিলেন, তসলিম উদ্দিন কখনো তার মেয়ে তুরিন আফরোজকে উত্তরার সম্পত্তি দানপত্র করেননি। বরং শামসুন্নাহার তার ছেলে শাহনেওয়াজকে উত্তরার সম্পত্তি ১৯৯৭ সালে হেবা করে দেন। পরে ওই জমি শাহনেওয়াজের নামে নামজারি করে ১৯৯৯ সালে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছ থেকে ২৫ লাখ ঋণ নেওয়া হয়। রাজউকের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা বাড়িতে তারা ২০০২ সাল থেকে বসবাস করে আসছিলেন। এছাড়া ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। তাছাড়া ২০ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুরিন আফরোজসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে হেফাজতের সমাবেশে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ তদন্তের আবেদন করা হয়। যাতে শেখ হাসিনাসহ শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের নাম রয়েছে।