সাধারণত বুকে গুলীবিদ্ধ হয়ে তা পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়, কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলীবিদ্ধ বেশীর ভাগ রোগীদের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। এসব রোগীদের মাথা দিয়ে গুলী বিদ্ধ হয়ে তা পেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। আবার বুক দিয়ে গুলী ঢুকে তা সমান্তরাল ভাবে না বেরিয়ে পেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে বুঝতে পারি যে আন্দোলনকারীদের উপর হেলিকপ্টার কিংবা উঁচু দালান থেকে গুলী করা হয়েছে বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আসাসিক সার্জন ডা. মোস্তাক আহমেদ।
গতকাল মঙ্গলবার জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৯ম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে এ সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। সকালে এ মামলায় গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
গতকাল সকাল ১১টা ৩৫ থেকে বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দুই ধাপে সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। প্রথমার্ধে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে সাক্ষ্যগ্রহণ রেকর্ড করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে গতকাল পাঁচজন সাক্ষী নিজেদের জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মফিজুর রহমান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. মোস্তাক আহমেদ, ফেনীর ব্যবসায়ী আহত নাসির উদ্দিন ও শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের নানা মো. সাঈদুর রহমান। এখন পর্যন্ত এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৯ জন।
জবানবন্দি শেষে তাদের জেরা করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যান্যরা।
এর আগে, ২৫ আগস্ট অষ্টম দিনে পাঁচজনের সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়। তারা হলেন- জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী, একই হাসপাতালের রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা, শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা মোহাম্মদ ইদ্রিস, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার ও শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেলের মা হোসনে আরা বেগম।
মামলার ২৭তম সাক্ষ্যর জবানবন্দিতে মোস্তাক আহমেদ বলেন, গুলীবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা না দিতে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) ডাক্তাররা চাপ দিতেন। তারা বলতেন এরা সন্ত্রাসী, অতি উৎসাহী হয়ে তাদেরকে চিকিৎসা দেয়া যাবে না।
জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, আন্দোলনকারীদের চিকিৎসায় বাধা দিতে স্বাচিপের নেতৃবৃন্দের কথায় গত বছরের ২৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ৫ জন ডাক্তারকে বদলি করা হয়েছিল।
এই চিকিৎসক বলেন, গুলীবিদ্ধ হয়ে যখন আন্দোলনকারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স যোগে আসছিলো, তখন শহীদুল্লাহ্ হলের সামনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা রোগীদের পরিচয় যাচাই করতো। তারা আন্দোলনকারী গুলীবিদ্ধ রোগীদের ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে বাধা দিতো বলে জানান এই ডাক্তার।
ট্রাইব্যুনালকে মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৯, ২০, ২১ জুলাই এবং ৪ ও ৫ আগস্ট বেশিসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেই। ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চাকরি করার সুবাদে আমি আগেও গুলীবিদ্ধ রোগীদের চিকিৎসা করি। বেশির ভাগ গুলীবিদ্ধ রোগীর গুলীর ডিরেকশন ছিল ওপর থেকে নিচের দিকে। সাধারণত গুলীর ডিরেকশন থাকে নিচ থেকে ওপরের দিকে বা সমান্তরালভাবে। রোগীরা জানান, তাঁদের উঁচু জায়গা থেকে বা হেলিকপ্টার থেকে গুলী করা হয়েছে। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে মাথায় গুলী লেগে তা পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়।’
জুলাই-আগস্টের নৃশংসতার জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবি জানান মোস্তাক আহমেদ।
গত সোমবার ২৪তম সাক্ষী দিয়েছেন শহীদ আবদুর রাজ্জাক রুবেলের মা হোসনে আরা বেগম। তিনি বলেন, হাসিনা লোক দিয়ে আমার ছেলেকে মেরেছে। আওয়ামী লীগ নেতা সালাহউদ্দিন তাকে দুটো গুলী করেছে। অন্যরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। কত কষ্ট দিয়ে আমার একমাত্র ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে। ওর পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে। নাতনিটা সারাক্ষণ বাবার জন্য কাঁদে। তাকে সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই।’
হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে যখন শহীদ হয়, তখন তার স্ত্রী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। বর্তমানে আমার নাতির বয়স ১১ মাস চলছে।’
জবানবন্দিতে হোসনে আরা বলেন, ‘আমার চার মেয়ে। রুবেলই একমাত্র ছেলে। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় নাস্তা খেয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হয় রুবেল। দুপুর দেড়টার দিকে দেবিদ্বার থানাধীন বানিয়াপাড়া আজগর আলী স্কুলের কাছে রুবেল আহত হয়েছে বলে খবর পাই। এরপর সেখানে গিয়ে দেখি দুজন নারী কাঁদছেন। রাস্তায় প্রচুর রক্ত দেখতে পাই। সেখান থেকে আমি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগে থেকেই হোসনে আরার ছেলের বউ ও চার মেয়ে ছিলেন। তবে তিনি যেতেই ছেলের মৃত্যুর খবর দেন উপস্থিত লোকজন। ছেলের লাশ একনজর দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান হোসনে আরা। পরে ছেলের বউসহ মেয়েরা তাকে বাড়িতে নিয়ে যান।
জবানবন্দিতে রুবেলের মা বলেন, ‘ওই দিন রাত ৯টায় আমাকে থানায় ডেকে নেন এসআই নয়ন। ময়নাতদন্তের জন্য একটি কাগজে সই নেন তিনি। থানায় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানও ছিলেন। তিনি আমাকে বলেন- ‘নগদ সাত লাখ টাকা দিচ্ছি। দুটো দোকান দিচ্ছি। ছেলের বউ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। মামলা করার দরকার নেই’। তবে আমি তার প্রস্তাবে রাজি হইনি।
তিনি আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে রুবেলের লাশ বাড়িতে আনা হয়। পরে জানাজা শেষে বেলা ২টায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তবে আমার ছেলে যখন শহীদ হয়, তখন তার স্ত্রী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। বর্তমানে আমার নাতির বয়স ১১ মাস।
হোসনে আরা বলেন, আমার ছেলে ছিল বাসচালক। তার উপার্জনে আমাদের সংসার চলতো। কিন্তু ছেলে এখন আর নেই। আমরা এখন কীভাবে চলি তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
এসময় ছেলেকে হত্যার দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসি চেয়েছেন তিনি।
গত ২৪ আগস্ট সপ্তম দিনে সাক্ষ্য দেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী মো. গিয়াস উদ্দিন, একই প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলাম ও কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম। ২০ আগস্ট ষষ্ঠ দিনে জবানবন্দি দেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, একই হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীন, ইবনে সিনা হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাসানুল বান্না এবং শহীদ শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল।
১৮ আগস্ট পঞ্চম দিনের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন শহীদ আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি, শহীদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল ও রাজশাহীর প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন। ১৭ আগস্ট চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল। তারা হলেন- সবজি বিক্রেতা আবদুস সামাদ, মিজান মিয়া, শিক্ষার্থী নাঈম শিকদার ও শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহীনা বেগম।
৬ আগস্ট প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দি দেন রিনা মুর্মু ও সাংবাদিক একেএম মঈনুল হক। ৪ আগস্ট পঙ্গু হওয়া শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান ও দিনমজুর চোখ হারানো পারভীনও সাক্ষ্য দিয়েছেন। ৩ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার সূচনা বক্তব্যের পর প্রথম সাক্ষী হিসেবে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বীভৎস বর্ণনা তুলে ধরেন আন্দোলনে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি হিসেবে রয়েছেন। তবে নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন তিনি। কাঠগড়ায় তার উপস্থিতিতেই জবানবন্দি দিচ্ছেন সাক্ষীরা।
এর আগে, ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এই অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।