শেখ হাসিনাসহ জড়িতদের ফাঁসির দাবি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য দিতে গিয়ে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো: মাহফুজুর রহমান বলেছেন, গত বছরের ১৯ জুলাই যখন রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল, তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) লোকেরা এসে নতুন গুলীবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য তাকে চাপ দেন। চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে আনা গুরুতর আহত ১৬৭ জনের বেশিভাগের মাথার খুলি ছিল না।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল বুধবার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্যদানকালে তিনি এসব কথা বলেন।
জবানবন্দিতে চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার বিষয়ে জানার পরে তিনি হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে পরামর্শ করেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে আশঙ্কায় প্রস্তুত থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি। তাই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পরিচালকের নির্দেশনায় একটি জরুরি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়।
১৮ জুলাই থেকে হাসপাতালে গুলীবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, রোগীদের মাথা, হাত, পা, পিঠ, মুখ ও গলায় গুলি ও পিলেট বিদ্ধ ছিল। গুলীগুলো ছিল বড় আকারের। ৪/৫ অগাস্ট যেসব রোগী আসে তাদের অধিকাংশের মাথা, বুক, মুখ ও গলায় গুলীবিদ্ধ ছিল। বেশির ভাগের মাথার খুলি ছিল না। আমাদের হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলী ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও শয্যা সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান মাহফুজ।
তিনি বলেন, গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশির ভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ২৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ৭ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ১৯ জুলাই যখন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল তখন ডিবির লোকেরা এসে নতুন গুলীবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য আমাকে চাপ দেয়। বলে, আপনি অতি উৎসাহী হবেন না, আপনি বিপদে পড়বেন। তারা আরও বলে, যাদের ভর্তি করেছেন তাদেরকে রিলিজ করবেন না; এ বিষয়ে উপরের নির্দেশ আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই চিকিৎসক বলেন, তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্টারে রোগীদের জখমের ধরণ পরিবর্তন করে গুলীবিদ্ধের স্থলে সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি। আহত রোগীদের বয়স ছিল ১৩ থেকে ৩০ এর মধ্যে। তাদের অধিকাংশই ছিল শিক্ষার্থী।
ডাক্তার মাহফুজ নিজের নেতৃত্বে প্রায় ৩৩টি অস্ত্রোপচার করেছেন তুলে ধরে বলেন, অনেকগুলো বুলেট ও পিলেট আহত আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করেছি। অনেকগুলো গুলী ও পিলেট রোগীরা চেয়ে নিয়ে যায়। তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ তালিকামূলে দুটি পিলেট, একটি বড় বুলেট ও আরও একটি গোলাকার বুলেট জব্দ করেছে।
এই পর্যায়ে জব্দ তালিকার সেই বুলেট ও পিলেট আদালতে প্রদর্শন করা হয়।
সাক্ষ্যে মাহফুজ বলেন, যেসব রোগীর মাথার খুলি ছিল না, তাদের কয়েকজনের আইসিইউতে যন্ত্রণাকাতর অবস্থার ভিডিও ধারণ করেন ৭১ টিভির একজন সাংবাদিক এবং তা ৭১ টিভিতে প্রচার করা হয়।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালে একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। ভিডিওতে সাক্ষীকে চিকিৎসারত অবস্থায় দেখা যায়।
মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম তুলে ধরেন মাহফুজ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ যারা শেষ হাসিনার নির্দেশ কার্যকর করে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করা হয়েছে, তাদের বিচার ও ফাঁসি দাবি করেন এই চিকিৎসক।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এছাড়া একই হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীনও সাক্ষ্য দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত এ মামলার ১৫ জন সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন।
গতকাল ট্র্যাইব্যুনালে প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম। এ সময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরো দু’টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকা-ের ঘটনায়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।