রংপুর কোতোয়ালি জোন পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (এসি) মো. আরিফুজ্জামান ও তাজহাট থানার অফিসার ইনচার্জ রবিউল ইসলামের নির্দেশে চালানো গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে এমনটিই জানিয়েছেন এসআই (সশস্ত্র) মো. আশরাফুল ইসলাম।
গতকাল বুধবার আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৩০ আসামির বিরুদ্ধে ১৪ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। অন্য দুই সদস্য হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। এদিন বেলা সোয়া ১১টার পর সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন এসআই আশরাফুল। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আমি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইনসে কর্মরত ছিলাম। ওই দিন সকাল ৮টায় সিসি মূলে আমার নেতৃত্বে ১৪ জন ফোর্স নিয়ে সরকারি গাড়িতে করে রংপুর বেরোবির সামনে পার্কের মোড়ে রওনা হই। ৮টা ৪০ মিনিটে সেখানে আমাদের দায়িত্বে থাকা হারাগাছ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) (তদন্ত) নূর আলম ও পুলিশ পরিদর্শক (সশস্ত্র) খোরশেদ আলম স্যারের কাছে হাজির হই। দুপুর ১টার দিকে লালবাগ থেকে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল আসে। তাৎক্ষণিক আমাদের সবাইকে বেরোবির এক নম্বর গেটের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে দেন এসি (কোতোয়ালি জোন) আরিফুজ্জামান, এডিসি (ডিবি) মো. শাহ নুর আলম পাটোয়ারী ও তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম। একইসঙ্গে লালবাগ থেকে আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতাকে আটকে দেন এসি স্যার। একপর্যায়ে ছাত্রদের সঙ্গে তার বাকবিত-া হয়। একপর্যায়ে উপস্থিত সব ফোর্সকে হুইসেল, লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের নির্দেশ দেন তিনি।
আশরাফুল বলেন, লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান ছাত্র-জনতা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সিভিল পোশাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিলে ছাত্র-জনতা আরও উত্তেজিত হন। এরপর গ্যাসগান ইস্যু করা পুলিশ সদস্যদের গ্যাস ফায়ারের নির্দেশ দেন আরিফুজ্জামান। তার সঙ্গে এডিসি শাহ নুর, তাজহাট থানার ওসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ বিভূতী ভূষণ রায় ছিলেন। এসি আরিফুজ্জামান নিজেও গ্যাসগান ফায়ার করেন।
সাক্ষী আরও বলেন, গ্যাসগান ফায়ার করলে ছাত্র-জনতা আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরক্ষণে উপস্থিত সব পুলিশ সদস্যকে নিয়ে এক নম্বর গেটের ভেতরে চলে যান এসি স্যার। কিছুক্ষণ পর গেট ধাক্কাধাক্কি করে খুলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন ছাত্র-জনতা। ওই সময় পুলিশ সদস্যদের সামনের দিকে ডেকে শটগান ফায়ার করতে বলেন এসি, ওসি ও এডিসি। তাদের নির্দেশে শটগান ইস্যুকৃত পুলিশ সদস্যরা ফায়ার করতে করতে গেটের বাইরের দিকে যান। এছাড়া এসি আরিফুজ্জামান স্যার ও তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম স্যারের নির্দেশে এএসআই (সশস্ত্র) মো. আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়ও শটগান দিয়ে ফায়ার করেন। তাদের ছোড়া গুলি গিয়ে লাগে রাস্তায় দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ছাত্রের গায়ে। পরে আশপাশের কয়েকজন ছাত্র মিলে গুলিবিদ্ধ ছাত্রকে ধরাধরি করে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে নিয়ে যান। এরপরও ছাত্র-জনতার ওপর গ্যাসগান ফায়ার করেন এসি আরিফুজ্জামান স্যার। তিনি বলেন, বেলা পৌনে ৩টায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেট থেকে মডার্ন মোড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ৪টার দিকে এসি আরিফুজ্জামান স্যারের কাছে আমরা জানতে পারলাম রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ ছাত্র আবু সাঈদ মারা গেছেন। রাত সাড়ে ৮টায় সরকারি গাড়ি এলে সব সদস্যকে নিয়ে পুলিশ লাইনের উদ্দেশ্যে রওনা করি আমি।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এসআই আশরাফুলকে জেরা করেন পলাতক ২৪ আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত চার আইনজীবী ও উপস্থিত ছয়জনের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মঈনুল করিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা। এ মামলার গ্রেপ্তার ছয় আসামি হলেন- এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। তাদের উপস্থিতিতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন সাক্ষীরা।
গত ২৭ আগস্ট সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ৬ আগস্ট ৩০ আসামির বিরুদ্ধে ফর্মাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসিসহ ২৪ জন এখনও পলাতক রয়েছেন। তাদের পক্ষে গত ২২ জুলাই সরকারি খরচে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।