মো. ওয়ালিওর রহমান ও মো. সাইফুল্লাহ মাগুরা থেকে : মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নির্যাতিত ও ধর্ষণের শিকার হয়ে শিশু আছিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় মামলার রায়ে প্রধান আসামী হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসাথে এক লক্ষ টাকা জরিমানার আদেশও দেন আদালত। মামলার অপর তিন আসামী হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা খাতুন, ছেলে সজিব খান ও রাতুল খানকে খালাস দিয়েছেন আদালত। রায়ের পর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী শিশু আছিয়ার মা আয়েশা আক্তার। তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, তিন আসামীকে খালাস দেওয়ায় খুবই কষ্ট পেয়েছি। তারা ঘটনা ধামাচাপা না দিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে আমার মেয়েটি হয়তো বেঁচে থাকতো। আমি তাদের শাস্তি দেখতে চেয়েছিলাম।
গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারক এম জাহিদ হাসান এই চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচারক মামলার ১ নম্বর আসামী হিটু শেখ এর বিরুদ্ধে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের এবং সংশোধিত ২০০৩ সালের ৯/২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা জরিমানা করেন। মামলার অপর ৩ আসামী রাতুল ও সজিব শেখের বিরুদ্ধে ৫০৬ এর ২য় অংশের ধারায় এবং জাহেদা খাতুনের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেন।
মামলার রায়কে ঘিরে গতকাল শনিবার সকালে আদালত চত্বর এবং আশপাশ এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আদালত চত্বরে উৎসুক জনতার ভিড় জমে। ভিড় করে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরাও। সকাল ৯টায় আসামীদেরকে ঝিনাইদহ কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হয়। বিগত দিনগুলোতে বিচার চলাকালে আদালতে আনা নেওয়ার পথে আসামীরা সাংবাদিকদের দেখে চিৎকার করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেও এদিন ছিলেন একেবারেই নিশ্চুপ। রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময়ও তারা ছিলেন শান্ত। হেলমেটের মধ্য দিয়েও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হিটু শেখকে কাঁদতে দেখা যায়। তবে মুখে ছিল না কোনো শব্দ।
আলোচিত এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ৩৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এরপর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। যুক্তিতর্ক শুনানি চলে দুই দিন। রায়ের পর নিহত আছিয়ার মা আয়েশা খাতুন বলেছেন, ৩ আসামীর খালাসে তিনি খুশি নন।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাভোকেট এহসানুল হক সমাজী, মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মুকুল। আসামী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট সোহেল আহম্মেদ। অ্যাভোকেট এহসানুল হক সমাজী বলেন, এক নম্বর আসামীর মৃত্যুদণ্ডে আমরা খুশি। কিন্তু তিন জন খালাসে খুশি নই। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর ২১ দিনের মাথায় এবং মোট ১৪ কর্ম দিবসে মামলাটির বিচার কার্য সম্পন্ন করতে পারায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি মনিরুল ইসলাম মুকুল। তিনি বলেন, প্রধান আসামী হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এবং অপর তিন আসামীকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এই রায় পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। আসামী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সোহেল আহম্মেদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী চাইলে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবে। তিন আসামীর খালাস পাওয়ায় তিনি খুশি ।
প্রসঙ্গত মাগুরার শ্রীপুরের জারিয়া গ্রামের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ৮ বছরের শিশু কন্যা আছিয়া মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী মাঠ পাড়া গ্রামে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে ধর্ষিত হয়। তাকে প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ফদিরপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে আরো অবনতি হলে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে এবং সর্বশেষ সিএমএইচ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ র্ম্চা ২০২৫ তার মৃত্যু হয়। এতে সারাদেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে। এই ঘটনায় ধর্ষণ মামলার বিচার তরান্বিত করতে সরকার আইন সংশোধন করে।
৮ মার্চ ২০২৫ নিহত আছিয়ার মা আয়েশা বেগম বাদী হয়ে ৪জন আসামী করে মাগুরা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। বিষয়টি সারাদেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে। মামলার অন্য আসামীরা হলেন শিশু আছিয়ার ভগ্নিপতি সজিব শেখ, সজিব শেখের বড় ভাই রাতুল শেখ এবং রাতুল শেখের মা জাহেদা খাতুন। মামলার পর ৪ আসামীকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। মামলার প্রধান আসামী হিটু শেখ ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে দোষ স্বীকার করে। পুলিশ তদন্ত শেষে আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে। ১৭ এপ্রিল ২০২৫ইং এই মামলার নথি বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ইং সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
এর আগে শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামী পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ১৩ মে মঙ্গলবার শেষ হয়। ওইদিন সকালে এ মামলায় অভিযুক্ত সকল আসামীকে কড়া পুলিশি প্রহরায় আদালতে হাজির করা হয়। সকাল ১০টা হতে শুরু হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাগুরার নারী ও নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিজ্ঞ বিচারক এম জাহিদ হাসান উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনেন। এ মামলায় মোট ২৯ জন সাক্ষীর মৌখিক এবং দালিলিক সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ প্রসিকিউটর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত অ্যাটর্নি জেনারেল সমমর্যাদার অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সামাজিসহ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে নিযুক্ত আইনজীবীরা সাক্ষী ও দালিলিক প্রমাণাদির উপর যুক্তিতর্ক করেন।
পাশাপাশি মামলার সব তথ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে আসামীদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করে আদালতের নিকট প্রার্থনা করা হয়। আসামী পক্ষের আইনজীবী সোহেল আহম্মদ আদালতে মামলার বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরে আসামীদের নির্দোষ দাবি করে তাদের খালাস চান। পরে ১৭ মে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে বলে জানান বিজ্ঞ বিচারক এম জাহিদ হাসান। শিশু আছিয়ার পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী এ মামলার সকল আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করেন। গতকাল আলোচিত এই মামলার রায় শোনার জন্য আদালত ও এর আশপাশের লোকজন ভিড় জমান।