বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হামলা, গুলি চালিয়ে হত্যা-হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন-নিপীড়ন, অপহরন-গুমসহ বিভিন্ন অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ যাবত ৬শ ৭০ টি মামলা রুজু করা হয়েছে। এরমধ্যে ৪শ ৫৩ টি হত্যা মামলা। বাকী ২শ ১৭ টি মামলার অধিকাংশই হত্যাচেষ্টা ও অপহরণ মামলা। এসব মামলা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে গুম, খুন ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। সর্বোচ্চ মামলা ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) এলাকায় হলেও খুলনা ও রাজশাহী মহানগরী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোন মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি। খবর পুলিশ সদর দফতর সুত্রের।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে প্রথম মামলা হয় ১৩ আগস্ট। এর পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে মামলা হচ্ছে। শেখ হাসিনা ছাড়াও তাঁর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি), দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা হচ্ছে। এছাড়া, সাবেক সরকারি আমলা, বিভিন্ন পেশার এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন , সাবেক এমপি, সরকারী আমলা, বিভিন্ন পেশার লোকজনসহ শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ শতাধিক গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
সুত্র মতে, ঢাকার বাইরের মামলাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে অনেক স্থানীয় নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রেঞ্জভিত্তিক তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলার অগ্রগতি তদারক করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সব রেঞ্জের শতাধিক তদন্তকারীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাঁদের।
পুলিশ সদর দফতর, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানা সূত্রে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তথ্য থেকে জানা গেছে, গত বছরের আগষ্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ৬শ ৭০ টি মামলা। দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ৪শ ৫৩ টি হত্যা মামলা। এসব মামলার মধ্যে ঢাকা বিভাগে রুজু হয়েছে ৯৯ টি, চট্টগ্রামে ৩ টি, খুলনায় একটি, বরিশালে একটি, রাজশাহীতে ১১ টি, রংপুরে দুইটি, ঢাকা মহানগরীতে ৩২০ টি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৫ টি, গাজীপুর মহানগরীতে ৭ টি ও রংপুর মহানগরীতে ৪ টি। হত্যাচেষ্টা, অপহরনসহ অন্যান্য অভিযোগে মামলা হয়েছে ২ শত ১৭ টি। তারমধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬২ টি, খুলনা বিভাগে দুইটি, রাজশাহী বিভাগে ৫ টি, রংপুর বিভাগে ৪ টি, ঢাকা মহানগরীতে ১৩৩ টি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৩ টি, বরিশাল মহানগরীতে একটি, গাজীপুর মহানগরীতে ৩ টি, রংপুর মহানগরীতে একটি ও সিলেট মহানগরীতে ৩ টি। পরিসংখ্যান মতে, দেশের মহানগরীগুলোতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছে ৪শ ৮০ টি। এরমধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৩শ ৩৬ টি আর অন্যান্য ধারায় হয়েছে একশ ৪৪ টি মামলা। বাকী একশ ১৭ টি হত্যা মামলা হয়েছে মহানগরীর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবু সায়েদ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে প্রথম মামলা করা হয়। গত বছরের ১৩ আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে এস এম আমীর হামজা নামে এক ব্যক্তি এ মামলার আবেদন করেন। এরপরে বিচারক মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের জন্য থানাকে নির্দেশ দেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মিছিল, সমাবেশ করেছে। তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে। এতে বহু ছাত্র-জনতা নিহত ও আহত হন। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার ৪০ ফিট এলাকায় ছাত্র-জনতা শান্তপূর্ণ মিছিল সমাবেশ করছিল। সেখানেও পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। তখন রাস্তা পার হতে গিয়ে স্থানীয় মুদি দোকানদার আবু সায়েদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
দায়ের হওয়া উল্লেখযোগ্য মামলা.....
হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা : মো. রুমন নামের এক তরুণকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা রেকর্ড হয়। মামলার বাদী রুমনের বোন রুমিয়া আক্তার।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে গত ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন রুমন। এ সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে রুমনকে হত্যা করা হয়। গুলিটি লাগে তাঁর বুকের বাঁ পাশে। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ সেলিম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও আসামি করা হয়েছে।
গুলশানে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর গুলশান এলাকায় আবুজর শেখকে (২৪) গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গুলশান থানায় এ মামলা রেকর্ড হয়েছে। মামলার বাদী আবুজর শেখের মা ছবি খাতুন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় প্রগতি সরণির বারিধারা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিল চলছিল। তখন মিছিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতারা গুলি করেন। এ সময় আবুজর শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এর ৯ দিনের মাথায় মারা যান তিনি।
কিশোরকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা : রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় কিশোর সুলাইমানকে (১৬) গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কদমতলী থানায় এ মামলা করেন সুলাইমানের মা রেখা বেগম। মামলায় বলা হয়েছে, শনির আখড়ায় গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি চালান। এতে সুলাইমান গুলিবিদ্ধ হয়।
গাড়িচালককে গুলি করে হত্যাচেষ্টা : রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গাড়িচালক ইনছান আলীকে (২৬) গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১৩ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় করা মামলায় বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নেন ইনছান। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ আসামিরা মিছিলে গুলি ছোড়েন। এতে ইনছান গুলিবিদ্ধ হন।
ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর চানখাঁরপুলে ব্যবসায়ী সামছুল ইসলামকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৩ নভেম্বর। শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন সামছুলের খালাতো ভাই লিটন মিয়া। মামলায় বলা হয়, গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে চানখাঁরপুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করেন আসামিরা। তখন গুলিবিদ্ধ হন সামছুল। পরদিন তিনি মারা যান।
ভ্যানচালককে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর শাহবাগে পিকআপ ভ্যানচালক আবদুল্লাহ আল আবীরকে গুলি করে হত্যায় শেখ হাসিনাসহ ৮১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শাহবাগ থানায় ১৩ নভেম্বর করা মামলার বাদী আবদুল্লাহর মামাতো ভাই ফিরোজ হোসেন। মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৯ জুলাই রাত ৮টার দিকে শাহবাগের ছাত্র-জনতার মিছিল চলছিল। এ সময় যানজটে আটকা পড়েন আবদুল্লাহ। তখন আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ অন্য আসামিরা গুলি ছুড়লে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন তিনি মারা যান।
রামপুরায় গুলি করে হত্যা : রাজধানীর রামপুরায় নাজমুল হাসান নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যায় শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। গত বছরের ১২ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরা থানায় মামলাটি করেন নাজমুলের বন্ধু মো. মজিবুল্লাহ।
তরুণকে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর রায়েরবাগে মাহাদী হাসান (১৯) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছরের ৮ নভেম্বর মামলাটি কদমতলী থানায় রেকর্ড হয়।
বাড্ডায় মাদ্রাসাছাত্রকে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর বাড্ডায় হাফেজ মাসুদুর রহমানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছরের ৯ নভেম্বর বাড্ডা থানায় করা ওই মামলায় সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, আনিসুল হককেও আসামি করা হয়।
ভাটারায় যুবককে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর ভাটারা এলাকায় মনির হোসেন নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছরের ৪ নভেম্বর ভাটারা থানায় করা মামলায় হাসানুল হক ইনুকেও আসামি করা হয়।
মিরপুরে তরুণকে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর মিরপুরে পারভেজ হোসেন (২১) নামের এক তরুণকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়েছে গত বছরের ৪ নভেম্বর।
মগবাজারে গুলি করে হত্যার চেষ্টা : রাজধানীর মগবাজারে সোহেল (১৮) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৩৮ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৬ নভেম্বর রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়েছে।
সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা : যাত্রাবাড়ীতে সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছরের ৭ নভেম্বর মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানায় রেকর্ড হয়েছে। মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, যাত্রাবাড়ীতে খবর সংগ্রহের সময় গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হাতিরঝিলে গুলি করে হত্যা : রাজধানীর হাতিরঝিলে মো. বাবু নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৭৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছরের ৪ নভেম্বর মামলাটি হাতিরঝিল থানায় রেকর্ড হয়েছে।