# রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইন্ধনও
সবুজ শান্ত পাহাড় হঠাৎই হয়ে উঠলো অশান্ত। স্কুল পড়ুয়া কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনার বিচার চাওয়ার নামে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ যাবৎ প্রাণ গেছে তিন জনের। আহত হয়েছেন অনেকেই। গুইমারায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে দোকানপাট ও বসতি। অথচ যে কথিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন, সেই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার হয়ে ৬ দিনের রিমান্ডে। তারপরও কেন এতো জ¦ালাও পোড়াও, কেন এতো হতাহতের ঘটনা? কেনইবা আন্দোলন-এমন সবপ্রশ্নের উত্তর মিলছে না। পাহাড়ের শান্তি শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীগুলোর কাছেও নেই কোন জবাব। তারাও নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। এদিকে, শান্ত পাহাড়ী জনপদ অশান্ত হওয়ার নেপথ্যে কারণ খুজতে মাঠে নামে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। যাদের তদন্তে উঠে আসছে লোমহর্ষক কাহিনী। থেমে যাওয়া আন্দোলনকে ফের চাঙ্গা করে ইউপিডিএফ এর ছাত্র সংগঠন ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’। আর এতে যোগ দেয় জেএসএস-ইউপিডিএফ- কেএনএফ ও ম্রো ন্যাশনাল পার্টির (এমএনপি) সদস্যরা। যারা সবাই সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ বলে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। তারাই মূলত অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাধারন জনতাকে মাঠে নামতে বাধ্য করে। কারণ গত ৭ মাসে তিন পার্বত্য জেলায় ১০১টি চাঁদাবাজির ঘটনায় নজরদারীতে ছিলো এই সংগঠনের নেতারা। এ কারণে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে তারা মাঠে নামে। আর এসব কিছুর পেছনে রয়েছে পাশের একটি দেশের গভীর চক্রান্ত। মূলত পাহাড়কে অশান্ত করে নিজেদের ফায়দা লুটাই তাদের উদ্দেশ্য বলে সূত্রটি দাবি করেছে।
সূত্রমতে, গত ৭ মাসে পাহাড়ে ১০ টি চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে জেএসএস শন্তু লারমা গ্রুপ ঘটিয়েছে প্রায় অর্ধশত ঘটনা। পিছিয়ে নেই ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ। তারাও ৩০টি ঘটনা ঘটিয়েছে। অন্যদিকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ৮টি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ১১টি ঘটনায় জড়িত আছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আর চারটিতে ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি)। সবশেষ ধর্ষণ ঘটনায় তোলপাড়ের আগে গত ২৫ মার্চ খাগড়াছড়ির লারমা বাজারে আগুন দেয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। অগ্নিকা-ে প্রায় ২৪টি দোকান পুড়ে একেবারে নিঃস্ব হন ৩০ ব্যবসায়ী। ঈদ ও বৈসাবি উৎসবমুখর পরিস্থিতিতে চাঁদা না দেয়ায় এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটিয়েছে পাহাড়িরা। এর ২০ দিন আগেও একই ঘটনা ঘটায় চাঁদাবাজ গ্রুপগুলো। এভাবে প্রায় বছরে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি চাঁদাবাজি করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো, যা পরে অস্ত্র কেনায় ব্যবহার হয়। আর এই অস্ত্রের বেশিরভাগই পাশের একটি দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে পাহাড় যত অশান্ত থাকবে, অস্ত্র ও গুলির যোগান তত বাড়বে। আর এ কারনে পাহাড়ে অশান্তির পেছনে ওই দেশটির গোয়েন্দারা সব সময়ই কাজ করে আসে।
সূত্রমতে, গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর পাহাড়ের শান্তি ফেরাতে কঠোর হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধারাবাহিক অভিযানে গ্রেপ্তায় হয় শত শত সন্ত্রাসী। অনেকটা কমে আসতে শুরু করে চাঁদাবাজীর ঘটনা। এতে কোনঠাসা গোষ্ঠীগুলো পুরানো রুপে ফিরতে একটি উপলক্ষ খুঁজছিল। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষন চলে আসে এক কিশোরী ধর্ষণের অভিযোগ উঠার পর। এ ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক গ্রেপ্তার হলেও অস্ত্রের মুখে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার জন্য স্থানীয়দের চাপ দেয় গোষ্ঠীগুলো। ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটে। দেশীয় ও সংয়ক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয় আন্দোলনে। আক্রান্ত হন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যার প্রমাণও রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে।
জানা গেছে, সশস্ত্র চাঁদাবাজদের দাপটে অতিষ্ঠ তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দারা। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো গ্রুপ। যে এলাকায় যাদের আধিপত্য সেখানে তারাই চাঁদা আদায় করে। বাহ্যিকভাবে পাহাড়ের বাসিন্দাদের অধিকার নিশ্চিত করা আর শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার থাকতে দেখা গেলেও নেপথ্যে এসব সংগঠনের বেশিরভাগ কর্মীই চাঁদাবাজিতে সক্রিয়। আর এ নিয়ে তারা প্রায়ই পরস্পরের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। অপহরণ, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা অশান্ত করে তোলে পাহাড়কে। বেশিরভাগ ভুক্তভোগিই সীমিত আয়ের মানুষ। তালিকায় রয়েছে, বিভিন্ন লেক এলাকার লঞ্চ ও বোট মালিক, নৌকার মাঝি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, মুদিসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানদার, ব্যবসায়ী সমিতি, মাছ, গরু বা সবজি বিক্রেতা, হোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিক, সাধারণ চাষি অথবা ফলবাগানের মালিক, চাঁদের গাড়ির মালিকরা।
খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের আইজিপি গত মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একজন আধাঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। জড়িত আরও দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরও একটি গোষ্ঠী বিষয়টিকে ইস্যু করার চেষ্টা করছে। কেন করছে তা আমরা জানি না।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, পাহাড়ে সব রকমের সহিংসতাসহ সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজি বন্ধ না করলে পাহাড়ের সমস্যা সমাধান হবে না। পাহাড়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাম্প্রতিক ঘটনার পেছনেও ওই গ্রুপগুলোর হাত রয়েছে।
একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, পাহাড়গুলোতে বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালে প্রতিবেশী ভূখ-ে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশে কুকি-চিনের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০২২ সালের এপ্রিলে। প্রথমদিকে রাঙামাটি ও বান্দরবানের ৯টি উপজেলার সমন্বয়ে স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ পৃথক রাজ্যের দাবি তোলে তারা। বান্দরবান তাদের প্রাণকেন্দ্র হলেও বর্তমানে ছড়িয়ে পড়েছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়িতেও। এই সংগঠনের প্রধান নাথান বম বর্তমান ভারতে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সেখানে বসেই সে পাহাড়ি জনপদকে অশান্ত করার নীল নকশা তৈরি করেন।
তারা রাঙামাটি ও বান্দরবানের বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলায় সক্রিয়। যা আবার খাগড়াছড়ির লাগোয়া। তবে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম ও মিয়ানমারের চিন রাজ্য তাদের অন্যতম ঘাঁটি বলে গোয়েন্দারা দাবী করেন।
তিন পার্বত্য জেলায় কমপক্ষে ১৫ সম্প্রদায়ের বসবাস। এরা হচ্ছেÑ চাকমা, মারমা বা মগ, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই বা মিজো, পাংখো, বম, মুরং বা ম্রো, খিয়াং, খুমি, চাক, বনজোগি, খিও, কুকি ও রাখাইন। এর মধ্যে চাকমা হচ্ছে বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। এদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাকিরা হিন্দু, খ্রিস্টান প্রমুখ। এদের অধিকাংশই শান্তিপ্রিয় ও খেটে খাওয়া মানুষ। কুকি-চিন বাদেও জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বা সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), প্রসিত খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও ম্রো ন্যাশনাল পার্টির (এমএনপি) সদস্যরা বেশি সক্রিয়। এই চক্রের একাধিক সদস্য রয়েছে চাঁদাবাাজের তালিকায়। তারা হচ্ছেন, নাথান বম, ফ্লেমিং, চেওসিম বম ও রোয়ান লিন বম, বিপ্লব চাকমা ও গরান্টু চাকমা, সমাজ প্রিয় চাকমা বা প্রসিত চাকমা, গমেজ চাকমা, ইথু চাকমা, রবি চাকমা, সমির চাকমা বা তরেন চাকমা, অগ্রসর চাকমা, চোসেন্দ্র বা রিমিত চাকমা, গোয়েন্তা চাকমা, শ্রাবণ চাকমা, তারুম বা বিলাম চাকমা, সমন ত্রিপুরা, এগন্তন চাকমা, জলাইয়া, উজ্জ্বল, বিজয়, আদিরঞ্জন। এদের মধ্যে কে কার বা কোন গোষ্ঠীর লোক তা বোঝা মুশকিল। এ ছাড়া তারা খুব ঘন ঘন এলাকা ও নিজেদের নাম পরিবর্তন করে থাকে ।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জেলা সদরের সিঙ্গিনালা এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ। এ ঘটনার জেরে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সহিংসতায় তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারা উপজেলায় উদ্ভূত পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। সর্বত্রই বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা।