পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ অন্যদের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ বৃহস্পতিবার। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন পৃথক তিন মামলার রায় ঘোষণা করবেন।

২৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে আদালত রায়ের তারিখ ধার্য করেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম গতকাল বুধবার সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) তিন মামলার রায় ঘোষণা করবেন আদালত।

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে শেখ হাসিনা, জয় ও পুতুলের নামে ১০ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা হয় গত জানুয়ারিতে। গত ২৫ মার্চ প্রতিটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ৩১ জুলাই একই আদালত এ তিন মামলায় শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের এক মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামী ১২ জন। আরেক মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১৭ এবং অন্য মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১৮ জন আসামী। তবে তিন মামলায়ই শেখ হাসিনা আসামী। অন্য আসামীরা রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তারা।

গত ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য ও অন্যদের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা করে দুদক। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডের ৬টি প্লট তারা বরাদ্দ পান। ছয় মামলার বাকি তিনটি মামলা ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এ বিচারাধীন।

হাসিনা-কামালের মৃত্যুদ-ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ : মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে সাজা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

গতকাল বুধবার ৪৫৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ করেন ট্রাইব্যুনাল। রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের আপিল আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।

আসামী থেকে রাজসাক্ষী বনে যাওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

শেখ হাসিনাসহ আসামীদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগে বিচার শুরু হয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার সময় এসব অভিযোগকে দুটি বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে মোট ছয়টি অপরাধের জন্য দ- ঘোষণা করেন।

যে অভিযোগে শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-

প্রথম অভিযোগের অধীন তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে উসকানি, দ্বিতীয়টি হত্যা করার আদেশ, তৃতীয়টি হচ্ছে নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে নিস্ক্রিয়তা এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শাস্তিযোগ্য। এই তিন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে আমৃত্যু কারাদ- দেওয়া হলো।

অভিযোগ উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়, অনেকগুলো ঘটনা আছে। একটি হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছেন।

শেখ হাসিনা আরও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যা, যা সংঘটিত হয়েছে তার আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলে বর্ণনায় এসেছে। অন্য একটি ঘটনায় তিনি একই অপরাধ করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ। এ কারণে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই তিনটি ঘটনায় তাকে (শেখ হাসিনা) একটি সাজা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটি হচ্ছে মৃত্যুদ-ের সাজা।

এ সময় আদালতকক্ষে উপস্থিত অনেকে হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আপনাদের অনুরোধ করছি আদালতের ডেকোরাম বজায় রাখার জন্য। আপনাদের উচ্ছ্বাস, প্রত্যাশার প্রকাশ ট্রাইব্যুনাল কক্ষের বাইরে গিয়ে করলে সেটি আরও শোভনীয় দেখা যাবে।

যে অভিযোগে আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদ-

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ঢাকার চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায়। এ ঘটনার ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে তিনি দায়ী সহযোগিতার জন্য এবং নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ ও প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য।

উভয় (চানখাঁরপুল ও আশুলিয়া) ক্ষেত্রে ছয়জন করে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানের অধীনে আসাদুজ্জামান খান কামাল দায়ী বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে চানখারপুল ও আশুলিয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা। এসব ঘটনায় তাকে মৃত্যুদ-ের সাজা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

যে কারণে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পাঁচ বছরের কারাদ-

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেনÑপরিস্থিতি সম্পর্কে তার জানা সম্পূর্ণটা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি ৩৬ দিনের আন্দোলনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তার সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তার অবদান বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে পাঁচ বছরের কারাদ- প্রদানের।

রায়ের পর প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম সাংবাদিকদের বলেন, তিন আসামীর বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচটি অভিযোগকে ছয়টি কাউন্টে (ঘটনা বা বিষয়) ভাগ করে দুটি অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদ- এবং আমৃত্যু কারাদ- দেওয়া যায়। অপরাধের নৃশংসতা, গুরুত্ব ও গভীরতা বিবেচনায় তিনটি কাউন্টে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদ- এবং অপর তিনটি কাউন্টে আমৃত্যু কারাদ- দেওয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগেই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন, তিনি মৃত্যুদ- পাওয়ার যোগ্য, তবে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন এবং তার দেওয়া সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালের সঠিক রায় বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করেছেÑএসব দিক বিবেচনায়।

ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের হুবহু কপি নিম্নরূপ

শেখ হাসিনার মামলার রায়ে মোট দুটি অভিযোগ। ৬টি কাউন্ট। অভিযোগ ১ : তিনটি কাউন্ট।

কাউন্ট ১ : ১৪ জুলাই ২০২৪ তারিখ গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন।

কাউন্ট ২ : ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সাথে শেখ হাসিনার কথোপকথনে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে তাদের ফাঁসি দিব মর্মে উসকানি ও আদেশ দেন। অপরাধ সংঘটনে আসামীরা তাদের অধীনস্তদের কোনো বাধা প্রদান করেননি।

কাউন্ট ৩ : এরই ফলশ্রুতিতে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ কর্তৃক গুলী করে হত্যা।

শাস্তি : শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের আমৃত্যু কারাদ-।

অভিযোগ ২ : তিনটি কাউন্ট

কাউন্ট ১ : ১৮ জুলাই, ২৪ তারিখ শেখ হাসিনা সাথে তাপসের এবং পরবর্তীতে হাসানুল হক ইনুর সাথে কথোপকথনে দেখা যায়, আসামী শেখ হাসিনা ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়, আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হেলিকপ্টার এবং লেথাল উইপন ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরাধ সংঘটনে আসামীরা তাদের অধীনস্তদের কোনো বাধা প্রদান করেননি।

কাউন্ট ২ : যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্ট ২০২৪ চানখাঁরপুলে ছয়জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ গুলী করে হত্যা করে।

কাউন্ট ৩ : যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখ পুলিশ কর্তৃক আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে হত্যার পর তাদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

শাস্তি : শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদ-।