* সিটিস্ক্যানে মস্তিষ্কের ইসকেমিয়া বেড়েছে, অবস্থা এখনও সংকটজনক

* ফয়সল করিমকে পালাতে সহায়তাকারী নুরুজ্জামান রিমান্ডে

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য (এমপি) পদপ্রার্থী শরীফ ওসমান বিন হাদীকে গুলী করে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় জড়িত রাঘব বোয়ালরা এখনো ‘অধরা’। পুলিশসহ আইনশৃংখলাবাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ছে ‘চুনোপুঁটি’। এদিকে, ঘটনার পর থেকে পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক অভিযান নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন, নানা আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে সেসব অভিযানের ফলাফলও। তদন্তকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা ইতোমধ্যে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি নিয়ে ‘তালগোল’ পাকিয়ে ফেলেছেন বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ।

জুলাই অভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া হাদী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত শুক্রবার গণসংযোগের জন্য রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গিয়ে তিনি আক্রান্ত হন। চলন্ত রিকশায় থাকা হাদীকে গুলী করেন চলন্ত মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা আততায়ী। গুলীটি লাগে হাদীর মাথায়। গুরুতর আহত হাদীকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করার পর রাতেই তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদীকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।

সিটিস্ক্যানে মস্তিষ্কের ইসকেমিয়া বেড়েছে, অবস্থা এখনও সংকটজনক

সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালে চিকিৎসাধীন গুলীবিদ্ধ জুলাইযোদ্ধা হাদীর শারীরিক অবস্থা এখনো সংকটজনক এবং আগের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে সর্বশেষ সিটিস্ক্যানের রিপোর্টে তার মস্তিষ্কে ইসকেমিক পরিবর্তন রয়ে গেছে এবং কিছতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদের ভাষায়, আপাতত কোনো ক্লিনিক্যাল উন্নতির লক্ষণ নেই; তাই কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্টেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ওসমান হাদীর স্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জন এবং হাদীর চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত চিকিৎসক ডা. আব্দুল আহাদ এ তথ্য জানান। তিনি জানান, সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর শরিফ ওসমান হাদীর নতুন করে সিটিস্ক্যান করা হয়। সেই স্ক্যানের ফলে দেখা গেছে, তার মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহের ঘাটতিজনিত ইসকেমিয়া এখনো বিদ্যমান এবং আগের তুলনায় কিছতা বেড়েছে। একইসঙ্গে ব্রেনের নিউরোলজিক্যাল রিফ্লেক্সগুলোতেও উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি।

ডা. আব্দুল আহাদ জানান, হাদীর শারীরিক অবস্থা বর্তমানে ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড স্ট্যাটিক অর্থাৎ অবনতি হয়নি, আবার উন্নতিও হয়নি। তার হৃদযন্ত্র সাপোর্টের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রয়েছে এবং কিডনির ইউরিন আউটপুটও চিকিৎসা সহায়তার মাধ্যমে বজায় রাখা হচ্ছে।

এদিকে, হাদীর মাথার ভেতরে রয়ে যাওয়া গুলীর অংশটি অপসারণে নতুন করে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে কি না, এমন প্রশ্নও উঠেছে। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলীর অংশটি মস্তিষ্কের ডিপ সিলেট অঞ্চলে অবস্থান করছে। এই পর্যায়ে সেটি অপসারণ করলেও যে ব্রেন ফাংশনে দৃশ্যমান উন্নতি হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং অস্ত্রোপচার বা দীর্ঘ জার্নির ঝুঁকি বর্তমান শারীরিক অবস্থায় আরও জটিলতা তৈরি করতে পারে।

ডা. আহাদ বলেন, কিছু মহল থেকে তাকে সিঙ্গাপুরের বাইরে ইউকে বা যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার আলোচনা শোনা গেলেও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের মূল্যায়নে বিষয়টি এখনো বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সহ্য করার মতো শারীরিক সক্ষমতা তার আছে কি না, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের মতামত ও সম্মতিও গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।

সিঙ্গাপুরেই আপাতত চিকিৎসা চলবে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, বর্তমানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, হাদীর চিকিৎসা সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালেই চলবে এবং তা থাকবে কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্টের আওতায়। নিয়মিত ইনভেস্টিগেশন ও ক্লোজ মনিটরিং করা হচ্ছে। তবে প্রতিদিন আলাদা করে জানানোর মতো নতুন কোনো অগ্রগতি নেই বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে যে চিকিৎসা প্রোটোকল অনুসরণ করা হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় সিঙ্গাপুরেও সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাই দেওয়া হচ্ছে এবং সেটিই অব্যাহত থাকবে।

এদিকে দুপুরে হাদীর শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরে ইনকিলাব মঞ্চ। সংগঠনটির ফেসবুক পেজের একটি পোস্টে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করতে হলে প্রথমে শরীরকে সম্পূর্ণভাবে স্থিতিশীল করতে হবে। চিকিৎসা সিঙ্গাপুর অথবা ইংল্যান্ড যেকোনো জায়গায় হতে পারে। ব্রেন সক্রিয় করার জন্য অপারেশন প্রয়োজন। বর্তমানে মূল লক্ষ্য হলো শরীর আর ব্রেনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। ব্রেন ছাড়া শরীরের অন্য সব অঙ্গ সক্রিয় রয়েছে।

তার পরিবার তার জন্য বিশেষ দোয়া কামনা করেছে। এছাড়া, হাদীর চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার সরকার বহন করছে এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় উন্নত চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে তার পরিবারকে। গতকাল বুধবার ইনকিলাব মঞ্চ তাদের ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানায়।

ফয়সল করিমকে পালাতে সহায়তাকারী নুরুজ্জামান রিমান্ডে

হাদীকে হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামী ফয়সল করিম মাসুদকে পালাতে সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার মো. নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশীতা ইসলাম গতকাল বুধবার এই আদেশ দেন।

ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী জানান, নুরুজ্জামানকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল জোনাল টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহম্মেদ তার পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তারা রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন। শুনানি শেষে বিচারক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তা ও সোর্সের তথ্য থেকে জানা যায়, নুরুজ্জামান ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তিনি এ মামলার অপর আসামীকে গাড়িতে করে পালিয়ে যেতে ভাড়ার গাড়ি দিয়ে সাহায্য করেন এবং গাড়ির চালককে বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন। আসামীর সঙ্গে মামলার ঘটনায় জড়িত থাকার যথেষ্ট সাক্ষ্যÑপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এটি একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ওসমান হাদীর ওপর হামলার পরিকল্পনাকারী ও জড়িত ব্যক্তিদের অন্যদের শনাক্ত করা এবং হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারসহ মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামীকে পুলিশ হেফাজতে এনে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

গ্রেফতার হওয়ার পর ফয়সলের মা-বাবার পরিচয় জানতে পারেন প্রতিবেশীরা

হাদী হত্যাচেষ্টা মামলার মূল আসামী ফয়সল করিম মাসুদের মা-বাবা গত শুক্রবার ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ছোট ছেলে হাসান মাহমুদের বাসায় উঠেছিলেন। শুভাঢ্যা ইউনিয়নের হাসনাবাদ হাউজিং এলাকার ওই বাসা থেকেই গত সোমবার ভোরে তাদেরকে গ্রেপ্তার করেন র‌্যাব-১০-এর সদস্যরা।

এলাকাবাসী ও ভবনের বাসিন্দাদের সুত্রে জানা গেছে, হাসান মাহমুদ ছয় মাস ধরে ওই বাসায় বসবাস করে আসছেন। তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় কাঁচামালের ব্যবসা করেন। হাসানের পরিবারের সঙ্গে প্রতিবেশীদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। হাসান প্রতিদিন সকালে কাজে বের হয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসতেন। সোমবার ভোরে ফয়সলের বাবা মো. হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা. হাসি বেগমকে (৬০) গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় র‌্যাব।

গতকাল বুধবার ওই ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী মো. হারুন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, শুক্রবার হাসান মাহমুদের মা-বাবা বাড়িতে আসেন। সোমবার ভোরবেলা প্রশাসনের লোক এসে তাদের বিষয়ে জানতে চান। এরপর তারা দুজনকে নিয়ে যান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসানের এক প্রতিবেশী জানান, সোমবার ভোরে কয়েকটি গাড়ির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। এতগুলো গাড়ি দেখে ভয় পেয়ে যাই। একপর্যায়ে তারা আমাদের বাসায় ঢোকেন। পরবর্তী সময় জানতে পারি, হাদীকে হত্যাচেষ্টার আসামী ফয়সলের মাবাবাকে তারা গ্রেপ্তার করেছেন। এর আগে তাদের পরিচয় জানতাম না।

জবানবন্দী দিলেন বিচারকের খাসকামরায়

হাদীকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার মূল আসামী ফয়সল করিম মাসুদের মা-বাবাকে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মনিরুল ইসলামের খাসকামরায় এ জবানবন্দি দেন। ফয়সলের বাবা হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা. হাসি বেগম (৬০)।

ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপপরিদর্শক রোকনুজ্জামান জানান, গতকাল তাদের আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। এ মামলায় তারা দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা তা রেকর্ডের আবেদন করেন। পরে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তাদের বিচারকের খাসকামরায় নেওয়া হয়।

হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বর প্লেট উদ্ধার

হাদীর ওপর হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও হেলমেটটি উদ্ধার হয়েছে। একই সঙ্গে মোটরসাইকেলে ব্যবহৃত ভুয়া নম্বরপ্লেটটিও একটি ম্যানহোল থেকে উদ্ধার হয়েছে। এগুলো পরে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত রোববার সকাল পৌনে ৯টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বনলতা আবাসিক এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় এগুলো উদ্ধার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। গতকাল বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা এ তথ্য জানায়।

সিটিটিসি সূত্র জানা যায়, সিটিটিসির একটি টিম সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির নম্বরপ্লেট পরিবর্তনের বিষয়টি উদ্ঘাটন করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা শেরেবাংলা নগর থানাধীন পশ্চিম আগারগাঁও বনলতা আবাসিক এলাকায় একটি বাড়ির নিচতলার পার্কিং থেকে মোটরসাইকেল ও হেলমেটটি উদ্ধার করে। পরে ভুয়া নম্বরপ্লেট পরিত্যক্ত অবস্থায় ম্যানহোলের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়।

মোটরসাইকেলটির মালিকানা প্রসঙ্গে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির প্রথম মালিক ছিলেন আবদুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। পরে জনৈক শহিদুল, রাসেল, মার্কেটপ্লেস, ওবায়দুল ইসলাম, আনারুল, আনারুল থেকে আবার ওবায়দুল হয়ে শুভ নামের এক ব্যক্তি মোটরসাইকেলটি কেনেন। সব মিলিয়ে আটজনের হাতবদল হয়ে মাইনুদ্দিন ইসলামের নামের এক ব্যক্তি সর্বশেষ মোটরসাইকেলটি কেনেন। এ হামলার ঘটনায় জড়িত মূল সন্দেহভাজন ফয়সলের সহযোগী মো. কবিরের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মাইনুদ্দিন এটি কেনেন।

গুলী করা হয় হোন্ডা হর্নেট থেকে, রিমান্ডে সুজুকি জিক্সার মালিক

হাদীকে গুলী করার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিকানা ও নম্বর প্লেট ঘিরে তৈরি হয়েছে রহস্য। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মোটরসাইকেলের নম্বর শনাক্তের ভিত্তিতে আব্দুল হান্নান নামে একজনকে ওই গাড়ির মালিক দাবি করে তাকে আটক করে র‌্যাব-২ । তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই মোটরসাইকেলের প্রকৃত মালিক নন আব্দুল হান্নান।

ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে র‌্যাব-২ হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর শনাক্ত করে। নম্বরটি ছিল- ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬, যা ইংরেজি অক্ষরে লেখা ছিল। ওই নম্বর প্লেটের সূত্র ধরে র‌্যাব মোটরসাইকেলের মালিক হিসেবে আব্দুল হান্নানকে শনাক্ত করে। এরপর শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) ভোরে মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের এভিনিউ-২, সি-ব্লকের ২ নম্বর বাসা থেকে মোটরসাইকেলের মালিক সন্দেহে তাকে আটক করা হয়। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র‌্যাব-২-এর উপ-পরিদর্শক (এসআই) বিপ্লব বাড়ৈ তাকে পল্টন থানায় হস্তান্তর করেন। পরে পল্টন থানা পুলিশ আদালতে ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ড আবেদন করে, যা মঞ্জুর করেন আদালত।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে ভিন্ন তথ্য। র‌্যাব-২ যে মোটরসাইকেলের মালিককে আটক করেছিল, সেটি ছিল ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ সিরিয়ালের সুজুকি জিক্সার এসএফ মডেলের একটি মোটরসাইকেল। অথচ সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শরীফ ওসমান হাদীকে গুলী করার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ছিল হোন্ডা হর্নেট, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬। অর্থাৎ হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বরের শেষ ডিজিট ছিল ‘৬’, কিন্তু আটক করা হয় শেষ ডিজিট ‘৫’ থাকা মোটরসাইকেলের মালিককে।

ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬ সিরিয়ালের মোটরসাইকেলের মালিকানার কাগজপত্র সংগ্রহ করে দেখা যায়, মোটরসাইকেলটির রং ব্লু/সিলভার এবং এটি ২৬ মে ২০২৪ সালে রেজিস্ট্রেশন করা। অন্যদিকে, যে মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটের সূত্র ধরে আব্দুল হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়- সেটি সুজুকি জিক্সার এসএফ মডেলের ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের গাড়ি, যার রং অরেঞ্জ-সিলভার। সিসিটিভি ফুটেজে যেখানে স্পষ্টভাবে ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬ নম্বরের মোটরসাইকেল দেখা যায়, সেখানে ওই মোটরসাইকেলের মালিককে আটক করা হয়নি। বরং নম্বরের শেষ ডিজিটে পার্থক্য থাকার পরও ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের মোটরসাইকেলের মালিক আব্দুল হান্নানকে আটক করা হয়।

অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আব্দুল হান্নানকে যেই মোটরসাইকেলের মালিক হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই মোটরসাইকেলের ডিজিটাল নম্বর প্লেটটি ছিল ইংরেজিতে লেখা। অথচ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে ইস্যু করা সব ডিজিটাল নম্বর প্লেটই বাংলায় লেখা হয়।

এই তথ্যের ভিত্তিতে প্রশ্ন উঠছে- যারা শরীফ ওসমান হাদীকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলী চালিয়েছিল, তারা কি ইচ্ছাকৃতভাবে নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে?

ডিজিটাল নম্বর প্লেট বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) উপ-পরিচালক এস এম কামরুল হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে বিআরটিএ থেকে যে ডিজিটাল নম্বর প্লেট ইস্যু করা হয়, তা কখনোই ইংরেজিতে লেখা থাকে না। ডিজিটাল নম্বর প্লেট সবসময় বাংলা ভাষাতেই দেওয়া হয়। শুধু কাগজপত্র ইংরেজিতে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, কোনো অপরাধী বা প্রতারক অপরাধ করার জন্য নম্বর প্লেট ইংরেজিতে করে থাকতে পারে।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ ও ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬- এই দুই মোটরসাইকেলের মালিকানাই যাচাই করা হয়। সূত্রের দাবি, যে মোটরসাইকেল থেকে গুলী চালানো হয়, সেটির রং ছিল অরেঞ্জ/সিলভার এবং নম্বর ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫। অন্যদিকে ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬ নম্বরের মোটরসাইকেলটির রং ছিল ব্লু/সিলভার এবং গঠনের দিক থেকেও সেটি সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে মেলেনি। সে কারণে ওই মোটরসাইকেলের মালিককে আর আটক করা হয়নি। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পর ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের মোটরসাইকেলের মালিক আব্দুল হান্নানকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করে পল্টন থানায় হস্তান্তর করা হয়।

তদন্তের অগ্রগতি কী বলছে পুলিশ

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, যে মোটরসাইকেলটি থেকে গুলী করা হয়েছে, সেটি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। সিসিটিভি ফুটেজে হোন্ডা কোম্পানির একটি হর্নেট মোটরসাইকেল দেখা যায়। আব্দুল হান্নান যে মোটরসাইকেলটি শোরুমে বিক্রির কথা বলেছেন, সেটি ছিল ইয়ামাহা ভার্সন-৪ মডেলের। আর ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের মোটরসাইকেলটি ছিল সুজুকি জিক্সার মডেলের, যা তিনি আগেই অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।

এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় আব্দুল হান্নানের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওসমান হাদীকে গুলীর ঘটনায় এখন পর্যন্ত আব্দুল হান্নানের কোনো সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়নি। আদালতের তার সম্পৃক্ততা না পাওয়ার একটি প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে।