চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর একটি ডিজিটাল সাইনবোর্ডে ‘আওয়ামী লীগ আবার ভয়ংকর রূপ ফিরবে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ লেখা ভেসে ওঠে। এই ঘোষণার পর গোপালগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র তান্ডবের ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার দেশের বাইরে ফ্যাসিস্ট এই আওয়ামী লীগের বীভৎস্য রূপ দেখতে পেল গোটা বিশ^। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে যাওয়া দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ওপর যেভাবে তারা হামলে পড়েছে, নারী নেত্রীদের যেভাবে গালিগালাজ করেছে, তা আওয়ামী লীগের অতীতের লোমহর্ষক কাহিনীগুলোকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো এই আওয়ামী লীগের যেখানে আত্মশুদ্ধির এবং অভিযোগ মেনে নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কথা, সেখানে তারা অতীতের বীভৎস্য ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। এতেই বুঝা যায়, এরা যদি আবার ফিরে আসে, তাহলে দেশের মানুষ আরও ভয়াবহ নির্যাতনের মুখোমুখি হবে।
সূত্র মতে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ যেন তাদের অতীতের কার্যক্রমেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। তাদের আচরণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। রোববার রাতে জ্যাকসন হাইটস এলাকায় জড়ো হয়ে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নজিরবিহীন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেন। তাদের হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা জানান, জ্যাকসন হাইটস প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে প্রায় সবকিছুই বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে থাকে। সেখানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এমন মারমুখী আচরণে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। তাদের এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণের সাথে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া দোসররাও যোগ দিয়েছে।
সূত্র মতে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেবেন। তিনি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সফরসঙ্গী করেছেন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির শীর্ষ নেতারা এই সফরে যোগ দেন। এটা দেশের জন্য গর্বের ও আনন্দের। তাদের সফর উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে দলুগলো। কিন্তু হঠাৎ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা এসব শীর্ষ নেতার ওপর হামলা করেছে। এতে দেশের ভাব মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়েছে বলে মনে করছেন প্রবাসীরা।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা কাওসার আহমেদ বলেন, আমরা এ দেশের আইনের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। ফলে আমরা আইন হাতে তুলে নিইনি। আমরা পাল্টা জবাব দিলে আওয়ামী লীগের একটি সন্ত্রাসীও পালাতে পারত না। এতে অন্তর্বর্তী সরকার এবং আমাদের দলের দুর্নাম হতো। আমরা এ কারণে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছি।
বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, এসব সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও তা-বের মূল হোতা পলাতক শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তার অর্থায়ন ও ইন্ধনে আওয়ামী লীগ এ ধরনের বেপরোয়া আচরণ করছে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেন। এ বৈঠকে ড. ইউনূসকে প্রতিরোধের নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। তিনি বলেন, জয় এখন বাংলাদেশের কেউ নন। শেখ হাসিনার পতনের পর জয় তার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পায়ে ঠেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তিনি এখন সব ধরনের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের আমলে দেশ থেকে পাচার করে আনা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এখন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করছেন তিনি।
হামলার ঘটনাস্থলের অদূরে বসবাস করেন বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. আবুল হাসেম। তিনি বলেন, অনেক বছর দেশে যাইনি। সন্ত্রাস, ফ্যাসিবাদ কায়েম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অনেক দুর্নামের খবর সংবাদমাধমে পড়েছি। এখন নিজের চোখে দেখলাম। যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় এটা কল্পনাতীত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেটা করেছে, এটা আমাদের হতবাক করেছে। এখন আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, আওয়ামী লীগ কী কারণে দেশছাড়া হলো।
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণœ না করার আহ্বান জানিয়েছেন নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলের কর্মকর্তারা। একজন কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেয়, আক্রমণ করে এবং অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে, তা সকল হিং¯্রতাকে হার মানায়।
সূত্র মতে, আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নভেম্বরে নিষিদ্ধ করা হয় ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’খ্যাত বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। এরপর রাজপথে আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গত ১২ মে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। দল নিষিদ্ধ হলেও বসে নেই নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এদের একটি অংশ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অপর অংশটি ষড়যন্ত্র করছে। দুর্নীতি-লুটপাট, অর্থ পাচার, গণহত্যা, খুন-গুমসহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত আওয়ামী লীগের পলাতক সভাপতি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের পলাতক অন্য নেতারা কিন্তু চুপ হয়ে গেছে- এমনটা ভাবার কোনো কারণ বা যুক্তি নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, দুই ধরনের ষড়যন্ত্র করছে আওয়ামী লীগ। একটি হচ্ছে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তির মধ্যে বিভেদ তৈরি করা, অন্যটি হচ্ছে গোপনে নিজেদের শক্তিশালী করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করা।
নাটোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অডিও কথোপকথন সম্প্রতি ফাঁস হয়। ওই কথোপকথনে বিএনপি-জামায়াত যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, সেই নির্দেশনাও ছিল। ঢাকায় আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল বের করছেন ও গোপন মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছেন। নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি, আবার কেউ অনলাইনে মিটিংয়ে যোগ দিচ্ছেন। অনেকেই ধারণা করছেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বেশিরভাগ দেশ ছেড়েছেন। বাস্তবে তা কিন্তু নয়। ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও হত্যার ঘটনায় থানায় হওয়া মামলায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে থাকা আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন বলে একাধিক প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। জামিনে বের হয়ে আসা এক আসামির ভাষ্য, ‘জেলখেটে এসেছি, এখন আর জেলের ভয় নেই, এখন সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে অংশ নেব’।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ফলে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসকের অবসান ঘটে। হাজারো শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ফের বড় ফ্যাসিস্ট হয়ে ফিরে আসার জানান দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এমনকি এখন তারা দেশের মধ্যে সংগঠিত হতে শুরু করেছে। ঝটিকা মিছিলের পাশাপাশি প্রকাশ্যে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিতে গোপনে জড়ো হচ্ছে। একই সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া অব্যাহত আছে। শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের মিছিলে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা সংখ্যায় কম থাকলেও, ক্রমেই তা বড় হচ্ছে। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে রাজপথে প্রকাশ্যে ঝটিকা মিছিল করা নিয়ে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারা তাদের নেপথ্যে থেকে মদদ দিচ্ছে এবং কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে নামছেন। সন্দেহের তীর পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন ছাড়াও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দিকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনের মধ্য থেকে সবুজ সংকেত না থাকলে এত বড় গণহত্যার পর দলটির মাঠে নামার কথা নয়। বিশেষ করে প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী দোসররা কৌশলে সমর্থন ও উসকানি দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পুরোমাত্রায় আওয়ামী লীগের পাশে আছে। দলটির নেতাকর্মীদের নানাভাবে সাহস এবং শক্তি জোগাচ্ছে দেশটি। এর বাইরে দেশি-বিদেশি শক্তির অনেকেই গোপনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক ধরনের সখ্য গড়ে তুলেছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে তাদের পেছনে বিপুল পরিমাণ কালোটাকাসহ আর্থিক বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিদেশের মাটি থেকে। আর এসব কারণেই নতুন করে রাজনীতির মাঠে ফেরার সাহস ও সুযোগ পাচ্ছে বিতাড়িত এই দলটি।
শুধু সভা-সমাবেশই নয়, বিভিন্ন স্থানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে এরই মধ্যে। সম্প্রতি গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়কের ওপর হামলা চালিয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরের ওয়াসা মোড় এলাকার একটি অফিসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদকে অবরুদ্ধ করে হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
রাজনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের পতনের এক বছর পার হলেও দলটির নেতাকর্মীর কথায় বা আচরণে কোনো প্রকার পরিবর্তন দেখা গেল না। জুলাই-আগস্টে গণহত্যা নিয়ে সামান্য অনুশোচনা প্রকাশের ঘটনাও দেখা গেল না। বরং তারা তাদের অতীতের বীভৎস্য চেহারায় ফিরে যাচ্ছে। বিশেষ করে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার যেসব ফোনালাপ সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হয়েছে, তাতে দেখা মিলবে সেই আগের শেখ হাসিনার। তার কথাবার্তা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। ন্যূনতম কোনো অনুশোচনা নেই। একই রকম ক্ষোভ ও ক্রোধের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। দলীয় প্রধানকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ওদের (বিএনপি-জাময়াত, এনসিপি) বাড়িঘর আছে না? এখন আর বসে থাকার সময় নাই, ওদের বাড়িঘরে আগুন দিতে হবে সব দিক থেকে... কিছু আগুনের ব্যবস্থা মনে হয় আমাদের রাখা দরকার।