নাছির উদ্দিন শোয়েব: জুলাই বিপ্লবে সাভারে গণহত্যার নির্দেশদাতা ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেরার সেই ইউএনও (নির্বাহী কর্মকর্তা) রাহুল চন্দকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। এদিকে জুলাই বিপ্লবে শাহাদাতবরণকারী স্কুলছাত্র আলিফ আহমেদ সিয়াম হত্যাসহ সাভারের গণহত্যার নির্দেশ প্রদানকারী রাহুলকে গ্রেপ্তার দাবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজাপুরে মানববন্ধন করেছেন জুলাই যোদ্ধা, স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত এবং সাধারণ জনতা। রাহুলকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি হিসেবে বদলি করা হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে দাবি জানিয়েছে ঝালকাঠি জেলা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। ছাত্র হত্যা মামলার আসামী রাহুলকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন দল দুটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। অপরদিকে তার ওএসডির খবরে সাভারে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘ছাত্র আন্দোলনে গুলী চালানোর হুকুমদাতা রাহুল এখন রাজাপুরের ইউএনও’ এই শিরোনামে গত বুধবার দৈনিক সংগ্রামে খবর প্রকাশিত হয়।
জানা গেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকার অদূরে সাভারে স্কুলছাত্র আলিফ আহমেদ হত্যা মামলায় আসামী হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাহুল চন্দকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মোহাম্মদ বারিউল করিম খান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে সংযুক্ত করা হয়। রাহুল চন্দ গত বছর গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সাভারের ইউএনও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, রাজাপুর, ঝালকাঠি হিসেবে কর্মরত রাহুল চন্দকে তার বর্তমান পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হলো। বিসিএস ৩৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট ঢাকাগামী লং মার্চকে কেন্দ্র করে সাভারে ছাত্র জনতার মিছিলের ওপর পুলিশ গুলী চালালে গুরুতর আহত হয় সাভার ডেইরি ফার্ম স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আলিফ আহমেদ সিয়াম। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট সিয়াম মারা গেলে বাগেরহাটের গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত সিয়ামের বাবা বুলবুল কবির চলতি বছরের ৬ জুন সাভার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের পাশাপাশি তৎকালীন সাভারের ইউএনও রাহুল চন্দকে ৫নং আসামী করা হয়। মামলার পরও রাহুল চন্দ ঝালকাঠির রাজাপুরে ইউএনও হিসেবে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বিষয়টি নিয়ে নিহত ছাত্রের পরিবারসহ সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সাভারের ভয়াবহ জুলাই গণহত্যা, হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলা এবং ছাত্র আলিফ আহম্মেদকে গুলী করে হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহুল চন্দের গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় স্থানীয় মানুষ। এর আগে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ইউএনও রাহুল চন্দের বিচার ও প্রত্যাহারের দাবিতে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে জুলাই যোদ্ধা রাজাপুর উপজেলার আয়োজনে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের অংশগ্রহণে কর্মসূচি পালিত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে রাহুল চন্দকে ওএসডি করে মন্ত্রণালয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, রাজাপুর উপজেলার ইউএনও রাহুল চন্দ সাভারে ছাত্র হত্যার ৫নং এজাহারভুক্ত আসামী হলেও তাকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। এখনও তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছেন। যা জুলাই বিপ্লবের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। অবিলম্বে রাহুল চন্দকে চাকরি থেকে অপসারণ ও গ্রেপ্তার করতে হবে। এ সময় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জুলাইযোদ্ধা মোহাম্মদ মুসা, মোস্তাফিজ, উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া সুমন, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মাওলানা বাইজিদ, জামায়াত নেতা আব্দুল আলীম ও ইসলামি ছাত্রশিবির সভাপতি সোলায়মান প্রমুখ। এদিকে রাহুল চন্দকে ঝালকাঠি থেকে অপসারণ ও তার বিচার দাবি করেছেন ঝালকাঠি জেলা বিএনপি ও জেলা জামায়াতে ইসলামী।
এ প্রসঙ্গে ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাত হোসেন বলেন, জুলাই বিপ্লবকালে হত্যাকা-ে নেতৃত্ব দেয়া একজন ব্যক্তি কীভাবে প্রশাসনে বহাল থাকে তা আমাদের বোধগম্য নয়। রাহুল চন্দ মামলার এজাহারভুক্ত আসামী। তাকে যেখানে গ্রেপ্তার করা দরকার, তা না করে তাকে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। এতে প্রমাণ হয় প্রশাসনে এখনও ফ্যাসিবাদের দোসররা ঘাপটি মেরে আছে। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ঝালকাঠি জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান বলেন, ভাবতে অবাক লাগে রাহুল চন্দের মতো দলীয় ক্যাডার ও গণহত্যার নির্দেশদাতারা কীভাবে এখনও প্রশাসনে বহাল রয়েছে। অবিলম্বে সাভারে জুলাই বিপ্লবে স্কুলছাত্র আলিফ আহমেদ সিয়াম হত্যা মামলার আসামী রাজাপুরের ইউএনও রাহুল চন্দকে গ্রেপ্তার এবং তার অপসারণ দাবি করছি। রাজাপুরে রাহুল চন্দের বিচারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের উদ্যোক্তা ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম আজম সৈকত বলেন, রাহুল চন্দকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত এবং রাজাপুর থেকে অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে হত্যাকারীদের রাজাপুরে কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না।
এদিকে সাভারে জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারের সদস্যরা এবং ফ্যাসিষ্ট বিরোধী জোট তার গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি করেছেন। সাভার পৌর বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও জুলাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধা নাসির উদ্দিন উকিল জানান ফ্যাসিষ্টদের শিরোমনি সাবেক ইউএনও রাহুল চন্দ ওএসডির খবর পেয়ে আমরা দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সাভার পৌর এলাকায় বিভিন্ন মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করেছি। জুলাই আন্দোলন কালে সকাল হলেই সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দপ্তরে দেখা যেত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেলা প্রশাসনের সভার নামে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রায় প্রতিদিন নিয়মিত বৈঠক ও ব্রিফিংয়ের জন্য ডাকতেন। সভায় ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহিল কাফি, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম,থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ জামান, আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ, র্যাব সদস্য, আনসার সদস্য, বিজিবিসহ অনেকেই উপস্থিত থাকতেন। সড়ক থেকে আন্দোলন কারীদের হটাতে প্রায়ই আঙ্গুল উচিয়ে হাত নেড়ে গুলী করার নির্দেশ দিতেন তিনি। সেরকম একাধিক ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ২০ ও ২১ জুলাই সাভার ও আশুলিয়ায় শতাধিক বিএনপি ও জামায়ত নেতাকর্মীর বাড়িতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হামলা,ভাংচুর এবং লুটপাট করা হয়েছিল। এ ঘটনার নেপথ্য নায়কও ছিলেন এ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আন্দোলনের দিন গুলোতে ঢাকার উত্তর প্রবেশ দ্বার সাভারে ঢাকা আরিচা মহাসড়কসহ আশুলিয়া থানার গুরত্বপূর্ন এলাকা বরাবরই ছিল বেশ উত্তাল। ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশ আর ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগের হামলার নেতৃত্বে দেখা যেত তৎকালীন ইউএনও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রাহুল চন্দকে। সকাল হলেই তিনি গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট চাপিয়ে নিতেন। আন্দোলন দমাতে জেলা প্রশাসনের মিটিংয়ের কথা বলে নিজ কাযালয়ে ডেকে বৈঠক করে আন্দোলন দমাতে সংঘবদ্ধ হয়ে বিপুল সংখ্যক সড়কে নামতেন তিনি। তার সাথে ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতার কথা চিন্তা করে রাখতে সহকারি কমিশনার (ভূমি) রাসেল নুরকে। সাভার আশুলিয়া জুলাই আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। সকল হত্যাকান্ডে ঘুরে ফিরে আসছে তৎকালীন ইউএনও রাহুল চন্দের নাম। তিনি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্রগামের বাসিন্দা ও ৩৫তম ব্যাচের বিসিএস রাহুল সর্বদা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এমন পরিচয় দিতে স্বস্তি বোধ করতেন। সাভারে তার যোগদানের ঘটনাটি ছিল বেশ নাটকীয়। অনুসন্ধানে জানাগেছে সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফেরদৌস ওয়াহিদ পদোন্নতি পেয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলী হওয়ায় তার স্থলাভিসিক্ত হয়েছিলেন শেখ নুরুল আলম।
জামায়াতে ইসলামের ঢাকা জেলার রাজনৈতিক সেক্রেটারি ও সাভার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর হাসান মাহবুব মাষ্টার জানান, জুলাই আন্দোলনকালে ২১ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা তার সাভার পৌর এলাকার ডগরমোড়ার বাসায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করে। এ ঘটনার সময় সাবেক ইউএনও রাহুল চন্দ ঘটনাস্থলের কাছেই একটি গাড়িতে বসেছিলেন। একাধিক ব্যক্তি তাকে গাড়িতে বসে থাকতে দেখেছেন। সাভার পৌর বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও আহত জুলাই যোদ্ধা নাসির উদ্দিন বলেন, ফ্যাসিষ্টদের শিরোমনি সাবেক ইউএনও রাহুল চন্দ ওএসডির খবর পেয়ে আমরা দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সাভার পৌর এলাকায় বিভিন্ন মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করেছি। তার যথাযথ শাস্তির দাবি জানান তিনি। মামলার অগ্রগতি বিষয়ে ঢাকা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন জানান, জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিষ্ট আমলে সাভারের ইউএনও, এসিল্যান্ডসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা জড়িত। আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা কেহ রেহাই পাবেন না। এ সকল মামলার দিকে তীক্ষè নজর রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন ইউএনও রাহুল চন্দ দাড়িয়ে থেকে গুলী করার নির্দেশ দিয়েছেন যার প্রমান রয়েছে। এ সব বিষয়ে জানতে বতমানে ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলা থেকে ওএসডি হওয়া উপজেলা নিবাহী কমকতা রাহুল চন্দকে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি বারবারই ফোন রিসিভ করেননি।