বাংলাদেশ ব্যাংকের ফেডারেল রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার লুটের ঘটনায় বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বহুল আলোচিত এ মামলা তদন্তে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সংশ্লিষ্টতার তথ্য বেরিয়ে আসছে। ঘটনার তদন্তকারী পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থার (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিস্থিতি বিবেচনায় বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়নি। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রিজার্ভ চুরির মূল পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করতে কয়েকটি ক্লু পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।
রিজার্ভ লোপাটের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর আইটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জড়িত থাকার বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানের স্বার্থে বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, কারাগারে থাকা বিএফআইইউর সাবেক প্রধান (ডেপুটি গভর্নর) মাসুদ বিশ্বাস, সাবেক ডেপুটি গভর্নর শুভঙ্কর সাহা, সুইফট কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি আনিস এ খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরিকল্পনা করছে সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে একজন আইনজীবীকেও। এছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদ করার পরিকল্পনা রয়েছে কারাগারে থাকা হাসিনার আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সবুজ সংকেত পেলে এদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেছেন, মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে। তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, স্বাধীনভাবে তদন্ত হবে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে গত বছরের ১১ জুলাই সিআইডি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একজন প্রভাবশালী আইনজীবী (যার যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছে) ধমক দেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। বৈঠকে তৎকালীন সিআইডি প্রধান সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলীও অধস্তন এই কর্মকর্তাদের চাকরি খাওয়ারও হুমকি দেন। বহুল আলোচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় অজ্ঞাত হ্যাকারদের নাম উল্লেখ করে যেনতেনভাবে চার্জশিট দেওয়ার জন্য ওই বৈঠকে এভাবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাপ প্রয়োগ করা হয়। এই বৈঠকের আগে ৮ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রিজার্ভ চুরির মামলা তদন্তে গভর্নর আতিউরের প্রতিনিধি হিসেবে বর্তমানে কারাগারে আটক বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এবং সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী সব বিষয়ে দেখাশোনা করতেন। পরে জুলাই আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে ফরমায়েশি চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হয়নি। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে তদন্ত কাজে সর্বাপেক্ষা ভালো ফলাফল পাওয়া যেত। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া পালিয়েছেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় এদের জিজ্ঞাসাবাদ করা আপাতত সম্ভব না হলেও কারাগারে থাকা উক্ত কয়েকজনকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে ঘটনার মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজে বের করা যাবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটলেও ৪১ দিন বিষয়টি গোপন রাখা হয়। এই সময়ের মধ্যে গভর্নর আতিউর রহমান সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করেন।
মামলার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এসে বরখাস্তকৃত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ভাবছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। কারণ রিজার্ভ চুরির পরপরই (তখন র্যাবে দায়িত্বরত) জিয়াউল আহসানকে বাংলাদেশ ব্যাংকে গোপনে ডেকে নিয়ে আসেন গভর্নর আতিউর রহমান। জিয়া সঙ্গে নিয়ে আসেন একজন প্রাইভেট আইটি এক্সপার্টকে। শুধু তা-ই নয় ভারতীয় বেসরকারি কম্পিউটার এক্সপার্ট রাকেশ আস্তানাকে ডেকে আনেন আতিউর রহমান। ৪১ দিন পর যখন মামলা হয়, তখন তদন্ত সংস্থা অনেক আলামত আর উদ্ধার করতে পারেনি। তদন্তকারীরা সে সময় জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সাহসও করতে পারেনি। জিয়াউল আহসানকে ডেকে নেওয়ার পাশাপাশি পরামর্শ নেওয়া হয় নীলা ভানান, আর্থরেশ নামে ভারতীয় এক্সপার্টদের। জিয়াউল আহসান কী করেছিলেন, তাকে কী কী করতে বলা হয়েছিল; এসব নানা বিষয়ে জানা দরকার তদন্তকারীদের।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, গত বছরের জুন মাসের শেষদিকে হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজ মন্ত্রণালয়ে জরুরি তলব করেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তাদের। তখনকার সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে মোহাম্মদ আলী মিয়া তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বলেন, দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তিনি যেভাবে বলবেন সেভাবে জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকজন কর্মকর্তাকে প্রমোশন ও মোটা অংকের প্রলোভন দেখান মোহাম্মদ আলী মিয়া। আরটিজিএস-এর মাধ্যমে সুরক্ষিত ও অতীব স্পর্শকাতর সুইফট সিস্টেমে প্রবেশাধিকারের জন্য সুইফট কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি আনিস এ খান কী কারণে তদবির করেছিলেন, তা জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র বলছে, আলাদা চ্যানেল তৈরি করে কোথাও কোথাও স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে এভাবে আরটিজিএস সুবিধা দেওয়া হলেও আর্ন্তজাতিক সুইফট সিস্টেমে একই চ্যানেলে সুবিধা দেওয়ার নজির পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। কিন্তু মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি আনিস এ খান কোনো চাপে পড়ে সুইফট সিস্টেমে প্রবেশাধিকারের জন্য সুপারিশ করেছিলেন কি না, তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় নাগরিক প্রীতম রেড্ডির কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার পর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ভারতীয় আইটি এক্সপার্টরা আইপি এড্রেস পরিবর্তন করে ফেলেন। যা বড় ধরনের প্রশ্ন তৈরি করে।
সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভ চুরি হওয়ার ২২ দিন পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে (মৃত) গভর্নর আতিউর রহমান ঘটনা জানালে ক্ষুব্ধ হন মন্ত্রী। কেন এতদিন গোপন করেছিলেন আতিউর এবং এ ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে, তা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখান মন্ত্রী মুহিত। তবে এক পর্যায়ে আর কোনো কথা বলেননি মন্ত্রী মুহিত। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনার চাপের কারণে চুপ হয়ে যান মুহিত। কর্মকর্তারা বলছেন, আতিউর রহমান সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলতেন। ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ লোপাট হয়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বাধ্য হয়ে ১৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলার বাদী বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা। অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনের ওই মামলায় সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি। মামলাটি তদন্ত করে আসছে সিআইডি। মামলায় চুরি শব্দটি উল্লেখ না করা নীলনকশার অংশ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ড. ফরাস উদ্দিনের তদন্ত কমিটি ২০১৬ সালের প্রথম দিকে রিপোর্ট জমা দেয়। সে রিপোর্টে আতিউর রহমানের দায় ও গাফিলতি রয়েছে উল্লেখ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে ওই কমিটি। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এত বড় একটি ঘটনার পরিকল্পনাকারী কারা, মাস্টারমাইন্ড কে বা কারা তা উল্লেখ করা হয়নি। ওই রিপোর্টটি দুই বছর আটকে রাখে অর্থ মন্ত্রণালয়। রিজার্ভ চুরির পর ১৭ জন চীনা নাগরিক ফিলিপাইন থেকে পাঁচ ধাপে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার উঠায়। অবশ্য তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি এর মধ্যে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করে। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা পর্যালোচনা করতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে সভাপতি করে গত ১২ মার্চ উচ্চ পর্যায়ের ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক আলী আশফাক ও রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল হুদাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্ত কাজের অগ্রগতি ও এ বিষয়ে সরকারের নেওয়া অন্যান্য পদক্ষেপ পর্যালোচনা, এ ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। এছাড়া প্রয়োজন অনুসারে সভা করতে পারবে কমিটি। কমিটি সিআইডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সুইফট কোডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ফেডারেল রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার ‘লুট’ করা হয়। স্থানান্তরিত এসব টাকা পাঠানো হয়েছিল ফিলিপাইনে তিনটি ক্যাসিনোতে। দেশের অভ্যন্তরেই কোনো একটি চক্রের সহায়তায় এই অর্থ পাচার হয়েছে বলে তখন ধারণা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। রিজার্ভ চুরির তিন বছর পর ২০১৯ সালে ওই অর্থ উদ্ধারের আশায় নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে একটি মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই মামলা খারিজে আবেদন করে আরসিবিসি। ২০২২ সালের এপ্রিলে নিউ ইয়র্কের আদালতে আরসিবিসির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলাটি খারিজ করে দেয়।