নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো: বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সরকারি জমি ব্যক্তিমালিকদের নামে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে নথি গায়েব, এরপর নানা কারসাজি করে সম্পন্ন হচ্ছে নামজারি। গত ছয় মাসে শহরের প্রাণকেন্দ্রে কয়েক হাজার কোটি টাকার অন্তত ৫০ একর সরকারি জমি ভুয়া মালিকদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, এসব হস্তান্তরের আড়ালে শত কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং দুদক মাঠে নামে।

প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে-বালাম বইয়ে ঘষামাজা করে জমির শ্রেণী পরিবর্তন, নথি গায়েব, আদালতে আপিলে না যাওয়া এবং ভুয়া মালিকদের কাছে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার মতো একের পর এক চাঞ্চল্যকর অনিয়ম। বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট অভিনব কৌশলে সরকারি জমি আত্মসাৎ করছে।

সরকারি স্বার্থ হারানো ও নথি গায়েবের কৌশল : প্রথমে সরকারি জমির নথি গায়েব করা হয়। পরে প্রমাণের অভাবে আদালতের রায় আসে ভুমিদস্যুদের পক্ষে। আপিল না করে জেলা প্রশাসন জানিয়ে দেয়, জমিতে সরকারের স্বার্থ নেই। এরপর তড়িঘড়ি করে সম্পন্ন হয় নামজারি। চট্টগ্রামে খাস, অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তির পরিমাণ অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি। এই সুযোগে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে শক্তিশালী ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। এদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ভূমি অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।

হিলভিউ আবাসিক এলাকা: চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ সীমান্তের হিলভিউ আবাসিক এলাকা ৩৫-৪০ বছর আগে ছিল পাহাড়ি জঙ্গল। বর্তমানে এখানে ২০০টির বেশি বহুতল ভবন রয়েছে। অথচ ৫৮ দশমিক ৭৩ একর জমির মধ্যে ৪৬ একর খাস এবং ১০ একর ত্রাণ বিভাগের সম্পত্তি। ১৯৮০ সালের দিকে হিলভিউ আবাসিক কল্যাণ সমিতি গঠন করে ঐ সম্পত্তি দখলে নেয়া হচ্ছে। সরকারি মালিকানা থাকায় দুই দশক ধরে নামজারি বন্ধ ছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র দুই মাসে ১৭৮টি প্লটের নামজারি সম্পন্ন হয়েছে। অথচ নথি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হিলভিউয়ের জমির কোনো সরকারি দলিল জেলা প্রশাসকের রেকর্ডরুম, তহসিল বা নগর ভূমি অফিসে সংরক্ষিত নেই। তিনটি অফিস থেকেই নথি গায়েব করে দিয়েছে সিন্ডিকেট। সরকারি স্বার্থ সুরক্ষায় দ্বিতীয়বার আপিল বা রিভিউ করারও চেষ্টা করা হয়নি।

হিন্দু থেকে খ্রিষ্টান সেজে ইহুদির জমি দখল: ১৮ শতকের শেষে চট্টগ্রামে স্থায়ী হওয়া বাগদাদি ইহুদি ডেভিড ইজিক্যালের ফিরিঙ্গীবাজারের সম্পত্তি দীর্ঘদিন সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের নেতৃত্বাধীন চক্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা এলবার্ট সরকারকে ভুয়া ওয়ারিশ সাজিয়ে দখলের চেষ্টা করে। অবশেষে চলতি বছরের ৫ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকার আমলে জেলা প্রশাসন জমি বুঝিয়ে দেয় এলবার্ট সরকারের নামে, যদিও এলাকাবাসী তাকে কখনো দেখেনি।

শিল্পকলার পাশের ৮৭ শতাংশ জমি: মুক্তিযুদ্ধকালে দেশত্যাগ করা অবাঙালি সৈয়দ আহমদ হাশেমীর ৮৭ শতাংশ জমি ১৯৮৭ সালে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে ভূমিদস্যুরা ভুয়া ওয়ারিশ ও জাল দলিল তৈরি করে দখলের চেষ্টা শুরু করে। তদন্তে দেখা গেছে, ৭৯ বছর বয়সে সন্তানের জন্ম দেখানোসহ নানান অসামঞ্জস্যতা রয়েছে নথিতে। তবুও জেলা প্রশাসন ভুয়া মালিকদের নামে হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে।

অভিযুক্তদের বক্তব্য : প্রাক্তন এসিল্যান্ড ইউসুফ হাসান বলেন, “বিএস রেকর্ড হাউজিং সোসাইটির নামে হওয়ায় সর্বোচ্চ আপিলের প্রয়োজন নেই।”

বর্তমান এসিল্যান্ড প্লাবন বিশ্বাস বলেন, “পিএস থেকে বিএস কীভাবে পরিবর্তন হলো, সে বিষয়ে আমি অবগত নই।” অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, “সব রায় সরকারের বিপক্ষে গেছে। যাচাই করে দেখা হয়েছে। সরকারের স্বার্থ না থাকায় জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের প্রশাসন কেবল হয়রানি করেছে, বর্তমান প্রশাসন সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

বিশ্লেষকদের মতে “৪০ বছরের বিরোধ এক রাতে সমাধান হওয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখানে বড় ধরনের কারসাজি আছে।” বিভাগীয় কমিশনারের বক্তব্য: চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের ড. মো. জিয়াউদ্দীন জানান, বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি হাতছাড়া নিয়ে তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এখনো নথি দেয়নি। ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটে সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। সরকার এবার চক্রের মূল হোতাদেরও চিহ্নিত করতে বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।