জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূলের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আগামী অক্টোবর মাসে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম।
গতকাল রোববার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন তথ্য জানান।
মিজানুল ইসলাম বলেন, মামলায় মোট সাক্ষী ৮১ জন। এর মধ্যে থেকে কম-বেশি সাক্ষ্যগ্রহণ করা হতে পারে।
এ মামলায় আসামি ও পরে রাজসাক্ষী হিসেবে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) কবে সাক্ষ্য দেবেন সেটা আগেই জানিয়ে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এ সময় প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল বলেন, আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাসে সাক্ষ্য শেষ না হলেও অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় সব সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ হবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক।
প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে লেখক-গবেষক ও বামপন্থি রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ মামলায় গতকাল দুপুর পর্যন্ত তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। তারা হলেন- আব্দুস সামাদ, মো. মিজান মিয়া ও নাইম শিকদার। বিকেলে আরও একজন সাক্ষ্য দেন। এ নিয়ে এ মামলায় মোট ৯ জন সাক্ষ্য দিলেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য মামলার কার্যক্রম আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আদালত।
এ মামলায় মাহমুদুর রহমান, নাহিদ ইসলাম ও বদরুদ্দীন উমর কবে সাক্ষ্য দেবেনÑজানতে চাইলে প্রসিকিউটর বলেন, ‘ওনাদের সঙ্গে আলোচনা করবো, ওনারা কবে আসতে পারবেন, সেভাবে আমরা করবো।
পাঁচ অভিযোগ
শেখ হাসিনা ও আসামিদের বিরুদ্ধে এই মামলায় মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের রাজাকারের বা”চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্ত...পক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্প...ক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।
দ্বিতীয় অভিযোগ, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪-দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ চলে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাঁদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বো”চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগ, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চতুর্থ অভিযোগ, রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চম অভিযোগ, শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এছাড়া এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রইব্যুনাল।
গত ১৬ জুন ট্র্যাইব্যুনাল-১ পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে হাজির হতে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং পরদিন দুটি পত্রিকায় শেখ হাসিনা ও কামালকে সাতদিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ এনে অভিযোগ গঠনের আবেদন করে প্রসিকিউশন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে চারটি মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তিনটিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে। এর মধ্যে দুটোতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এই চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে আশা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর কার্যালয়।