বাংলাদেশে গুমের প্রবণতা শুধু অপরাধ দমনে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়েছে—এমন চিত্র উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৫৩টি গুমের ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুম হয়েছে ২০১৭ সালে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগের বছর। ওই বছরেই এককভাবে ৫১টি গুমের তথ্য যাচাই করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ১০১ জনের রাজনৈতিক পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে বিএনপির ৩৭ জন, ছাত্রশিবিরের ৩১ জন, জামায়াতে ইসলামীর ২৫ জন এবং আওয়ামী লীগের দুজন রয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের গুমের ঘটনাগুলো দলীয় কোন্দল বা ব্যক্তিগত বিরোধজনিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড় অনুসন্ধানের বিষয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, গুমের ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার কৌশল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।
কমিশনের পরিসংখ্যানে আরও উঠে আসে, গুমের শিকারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ১৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণরা। এর মধ্যে ২৭-২৮ বছর বয়সীদের হার ছিল সর্বোচ্চ। কমিশনের মতে, এই বয়সসীমার মানুষ সাধারণত রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হন।
এ ছাড়া অন্তত ১০ জন গুমের শিকার ছিলেন ১৮ বছরের কম বয়সী। চরমপন্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নয়, বরং রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাই ছিল গুমের মূল কারণ—এমন অভিমত উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
পেশাগত পরিচয়ের দিক থেকে দেখা গেছে, গুমের শিকারদের মধ্যে ছাত্র ছিল ৬৬ জন, ব্যবসায়ী ৬৪ জন, শিক্ষক ৩৪ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ৩৩ জন, তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী ১০ জন এবং সাংবাদিক ৫ জন।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। কমিশনের তথ্যে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক ভুক্তভোগী ৪৭ দিনের কম সময় নিখোঁজ ছিলেন, বাকিরা আরও দীর্ঘ সময় ধরে আটক বা নিরুদ্দেশ ছিলেন। কেউ কেউ পাঁচ বছর পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন।
কমিশনের সদস্য ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণ সরাসরি পুলিশের মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ করেছিল। তখন নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থা হারায় মানুষ। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন ঘিরে সরকার প্রতিবাদ ঠেকাতে ‘নিঃশব্দে সরিয়ে দেওয়ার’ পদ্ধতি বেছে নেয়।”
তিনি আরও বলেন, “গুমের শিকারদের অধিকাংশই রাজনীতিতে সক্রিয় অথবা সক্রিয় হওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। তাঁদের নিশানা করাই ছিল উদ্দেশ্য।”
কমিশনের তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছরই গুমের ঘটনা ঘটেছে, একমাত্র ২০১২ সাল ছাড়া। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে গুমের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, যেখানে ২০১৭ সাল এককভাবে শীর্ষে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৬টি গুমের ঘটনা যাচাই করা হয়েছে।