নজরুল ইসলাম (৫৯) ও তাসলিমা আক্তারের (৪২) সংসার প্রায় ২০ বছরের। তাদের ঘরে তিনটি সন্তান। এত বছর সংসারের পরও নজরুল ইসলামের মনে সন্দেহ- তার স্ত্রী তাসলিমা পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন। এছাড়া এক কোটি ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে যেকোনো সময় স্ত্রী তাকে হত্যা করতে পারেন- এমন সন্দেহে স্ত্রীকে খুনের পর লাশ ডিপ ফ্রিজে লুকিয়ে রাখেন নজরুল ইসলাম। পরে সন্তানদের তাদের ফুফুর বাসায় রেখে পালিয়ে যান ঘাতক স্বামী।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বংশাল থানাধীন নবাবপুর রোড এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে কলাবাগান থানা পুলিশ। এ সময় বাসার ওয়্যারড্রব থেকে উদ্ধার করা হয় হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ধারালো দা। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য জানান রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম। তিনি বলেন, গত ১২ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে নজরুল ইসলাম কলাবাগান থানাধীন এলাকার একটি ফ্ল্যাটে ফিরে দেখেন ফ্ল্যাটের দরজার তিনটি লকের মধ্যে দুটি খোলা। স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের প্রতি দীর্ঘদিনের সন্দেহ- পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ও তার সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার ভয় তাকে উত্তেজিত করে। রাত ১২টার দিকে ঘুমন্ত স্ত্রীর মাথায় ধারালো দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেন তিনি। এরপর লাশটি গামছা দিয়ে বেঁধে, বিছানার চাদর ও ওড়না দিয়ে মুড়িয়ে বাসার ডিপ ফ্রিজে লুকিয়ে রাখেন।
পরে রক্তমাখা তোশক উল্টিয়ে, মেঝে পরিষ্কার করে এবং নিজের জামা-কাপড় ধুয়ে আলামত গোপনের চেষ্টা করেন। পরদিন সকালে নজরুল ইসলাম তার বড় মেয়ে নাজনীন আক্তারকে জানান, তাদের মা অন্য পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। এ সময় নাজনীন ঘরের দেওয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পান। পরে নজরুল ইসলাম তার দুই মেয়েকে নানা বাড়ি রেখে আসার কথা বলে রাজধানীর আদাবরে তাদের ফুফুর বাসায় রেখে নিজের প্রাইভেটকারে পালিয়ে যান। ডিসি মাসুদ আলম বলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ হলে নিহতের ছোট ভাই নাঈম হোসেন ও নিহতের দুই মেয়ে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কলাবাগান থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কলাবাগান থানা পুলিশের একটি টিম নিহতের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়ে ফ্ল্যাটের দরজার তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। অনেক খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ঘরের মধ্যে রাখা ডিপ ফ্রিজ খুলে ফ্রিজের ওপর থেকে মাছ-মাংস সরালে ফ্রিজের ভেতর চাদর দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় তাসলিমা আক্তারের লাশ দেখতে পায় পুলিশ।
তিনি বলেন, নিহতের পরিবারের লোকজন ও সিআইডির ক্রাইম সিন টিমের সহায়তায় কলাবাগান থানা পুলিশ ডিপ ফ্রিজের ভেতর থেকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে। নিহতের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের ঘটনায় ওইদিন রাতে তাসলিমার ছোট ভাই নাঈম হোসেন বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি রুজুর পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ, গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় কলাবাগান থানা পুলিশ নিহতের স্বামী নজরুল ইসলামের অবস্থান শনাক্ত করেন। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিজ বাসার ওয়্যারড্রব থেকে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ধারালো দা উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতার নজরুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে ডিসি মাসুদ আলম জানান, নজরুল ইসলাম ও তাসলিমা আক্তার দম্পতির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্ত কলহ চলছিল। নজরুল ইসলাম অবৈধ সম্পর্কের সন্দেহে স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। এমনকি সে ভয় পেত যে স্ত্রী তার সম্পত্তি ও ব্যাংকে রাখা অর্থ হাতিয়ে নেবে। চরম সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা থেকেই এই নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। রমনা বিভাগের ডিসি বলেন, নিহতের স্বামীর একটি অ্যাকাউন্টে ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিল এক কোটি টাকা। নমিনি ছিলেন তার স্ত্রী। আরেকটি অ্যাকাউন্টে ৪০ লাখ টাকা ছিল, সেটারও নমিনি স্ত্রীর নামে। এ টাকা হাতিয়ে নিতে স্ত্রী যে কোনো সময় তাকে মেরে ফেলতে পারে বলে সন্দেহ ছিল গ্রেফতার নজরুল ইসলামের।