স্বৈরাচার ভোট ডাকাত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ভারতে পালিয়ে ছিল। সেই পালানোর আর ১৩ দিন পর এক বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সিলেটে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ অস্ত্রধারী ক্যাডাররা আজও গ্রেফতার হয়নি। ধরা ছোয়ার বাইরে সিলেটের সেই অস্ত্রধারীরা। মাঝেমধ্যে বাসাবাড়িতে এসে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের গ্রেফতারে নেই কোন আগ্রহ। ৫ আগস্ট লুট হওয়া এসএমপি পুলিশের সেই ১৮ টি আগ্নেয়াস্ত্র আজও উদ্ধার হয়নি। এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড ক্ষোভ, উৎবেগ ও উৎকন্ঠা।
গতবছরের ৫ আগস্ট এসএমপি’র ৬টি থানায় ১০১টি বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল। এরমধ্যে পুলিশ বেশির ভাগ অস্ত্র উদ্ধার করলেও এখনো হদিস নেই ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের। দেশে একাধিকবার যৌথবাহিনীর অভিযান হলেও সিলেটের চিহ্নিত অস্ত্রধারী গ্রেফতার করা হয়নি, উদ্ধার হয়নি প্রদর্শিত অস্ত্র। এমনকি হদিস মিলেনি পুলিশের লুট হওয়া সেই অস্ত্রেরও।
জানা গেছে, গত ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা আনসার আহমদ রুহেল ওরফে শুটার আনসার ও তার সহযোগী আমিনুল ইসলাম নাঈমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৯। সে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। নগরীর টিলাগড় ও মেজরটিলার আতঙ্ক শুটার আনসারকে গ্রেফতার করা হলেও তার হাতে থাকা অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত জুলাই বিপ্লবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে পুলিশের পাশে থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দিয়েছিল যুবলীগ-ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসীরা। নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করা হয় ছাত্র-জনতার উপর। এসব দৃশ্য সিলেটের প্রায় সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। সকল অস্ত্রধারীই চিহ্নিত। এরপরও সেই সব চিহ্নিত অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী।
জনমনে এখনো প্রশ্ন- সিলেটের রাজপথে প্রদর্শিত এত আগ্নেয়াস্ত্র গেল কোথায়? অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি থানা থেকে লুট হওয়া ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার না হওয়া উদ্বেগজনক।
বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা জানিয়েছেন-জুলাই থেকে আগস্ট বিজয়ের দিন পর্যন্ত সিলেটের রাজপথে অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল। যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ পুলিশের সঙ্গে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অস্ত্রবাজরা তখনকার বিরোধীদলের কর্মীদের দমনে গুলি ছুড়েছে। আর গুলিতে শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। গত বছরের ১৯ জুলাই এসএমপি’র এডিসি দস্তগীরের গুলিতে নগরীতে বিএনপি’র মিছিল চলাকালে শুক্রবার বাদ জুম’আ নিহত হন দৈনিক নয়াগিন্তের সিলেট প্রতিনিধি এটিএম তুরাব। তুরাব হত্যার বিচার ত্বরান্বিত করা না হলে সাংবাদিক সমাজ আবারো রাজপথে নামবেন বলে গত ১৯ জুলাই সিলেট প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুরাব হত্যার ১ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন হুশিয়ারী দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটে গত বছরের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রথমে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণে শাবি শিক্ষার্থীদের ওপর ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়। পরে আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের সি ব্লকের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত শাহ’র ৪২৩ নম্বর রুম থেকে দুটি পিস্তল সাধারণ শিক্ষার্থীরাই খুঁজে বের করে। এরপর ২ আগস্ট থেকে শাবি ফটক ও মদিনা মার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলে সিলেটের যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা প্রকাশ্য অস্ত্র প্রদর্শন শুরু করে। ৩ আগস্ট পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়ায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন মারা যায়, সেদিন পুলিশকে পেছনে রেখে ফ্রন্টলাইনে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সুরমা আবাসিক এলাকায় অনবরত গুলি ছুড়ে। গুলির শব্দে ওইদিন সুরমা আবাসিক এলাকা প্রকম্পিত হয়। এর আগে ২ আগস্ট ও পরে ৪ঠা আগস্টও এসব এলাকায় গুলিবর্ষণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মদিনা মার্কেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান, তার সশস্ত্র ক্যাডার আজহার উদ্দিন সুমন, পাঙ্গাস ও তুহিনের নেতৃত্বে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এদিন সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান ওরফে মুরগি হান্নানের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র ক্যাডাররা মাঠে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলি ছুড়ে। পুলিশ যখন ছাত্র বিক্ষোভ দমাতে ক্লান্ত তখনই এই সব অস্ত্রবাজরা পুলিশের প্রক্সি হিসেবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে মাঠে নামে। এতে ওই এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন অগনিত শিক্ষার্থী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ৪ আগস্ট। সেদিন সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টা এলাকায় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলীবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এমনকি সেদিন তৎকালিন উপ-পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, তৎকালিন সহকারী কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরের সামনেই প্রকাশ্য দিবালোকে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া হয়। ৩ আগস্ট ঘোষণা দিয়ে পরদিন ৪ আগস্ট নগরীর কোর্ট পয়েন্টে বেলা ১১টার পর অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। তখন সিলেট বিএনপিসহ বিরোধী বলয়ের কর্মীরাও সেখানে জড়ো হন। দুপুরের দিকে পুলিশ অ্যাকশনে গিয়ে ওই এলাকায় তাদের সরিয়ে দিলে রাজপথ দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে সিলেট আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডাররা অস্ত্র নিয়ে মহড়া শুরু করে। এ সময় দফায় দফায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। আর এ সময় ঐসব এলাকায় শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর এ সময় রুহুল আমীন শিবলুর মরণঘাতি ভয়ানক অস্ত্রের বিষয়টি প্রকাশিত হয়। এছাড়া এই সময় আফতাব, জাহাঙ্গীর, দেবাংশু দাস মিঠু, আব্দুল আলীম তুষার ও আব্দুল হান্নান দলবল নিয়ে কোর্টপয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টাসহ নগরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিলো।
এর বাইরে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি পীযূষ কান্তি দে তার দলবল দিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। পীযূষের সঙ্গে থাকা তার এক সহযোগীর হাতে ছিল তার সেই বহুল আলোচিত দু’নলা বন্দুক। এ ছাড়া শটগান হাতে যুবলীগ নেতা জাহেদ, মুনিম অখিলি, সজল দাশ অনিক, শান্ত, টিলাগড়ের ভয়ঙ্কর আলোচিত অস্ত্রধারী আনসার ওরফে শুটার আনসার, এমসি কলেজের দেলোয়ার হোসেন রাহী, সরকারি কলেজের রুহেল আহমদ, রাজন আহমদ, ছাত্রলীগের তানভীর, সৈকত চন্দ্র রিমী, গৌরাঙ্গ দাশ সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। তারা ওইদিন গুলিবর্ষণ করে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত ছাত্র আন্দোলনে ৩ ও ৪ আগস্ট সিলেটের রাজপথে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যুবলীগ নেতা আবুল হোসেন, শিবলু, রেজা ও তোফায়েল ছাত্রজনতার উপর হামলা করে। এছাড়া ঐদিন কোর্টপয়েন্ট-জিন্দাবাজারে যুবলীগ ক্যাডার তুফায়েল, সাব্বির আহমদ, শাহ রুখনোজ্জামান রুখন, এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা তাজিম, আলি হোসাইন, আলমগীর, নিউটন চৌধুরী, হোসাইন আহমদ, দেলোয়ার হোসাইন, টেলেন্ট কান্তি দাস, অপু তালুকদার ও রনি তালুকদারের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের বিদায় ও শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ১১ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র শুটার আনসার ছাড়া আর কোন অস্ত্রধারী গ্রেফতার হয়নি। অনেকেই ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে জানিয়েছেন- অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রবাজদের ধরতে পুলিশ সবসময়ই সক্রিয় রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের সফলতা নাই বললেই চলে। অস্ত্রধারীদের চিহ্নিত করা গেলেও অধিকাংশরা দেশের বাইরে চলে গেছে। আর যারা দেশে আছে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালিন সিলেট জেলা সমন্বয়ক ও এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মূখ্য সমন্বয়ক গোলাম মর্তুজা সেলিম জানান, জুলাই বিপ্লবের এক বছর অতিবাহিত হলেও ছাত্র-জনতার উপর গুলীবর্ষণকারী আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ অস্ত্রধারী ক্যাডাররা গ্রেফতার না হওয়ায় নগরবাসী উদ্বিগ্ন। সিলেট জেলা পুলিশ ও এসএমপি পুলিশের যথেষ্ট গাফলতি রয়েছে নতুবা কেন এই অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্ন রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাতনেতা গোলাম মর্তুজা সেলিম।