সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫০ একর সরকারি জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। তাঁর দখলে থাকা জমি তিনি পাথর ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। দুই বছর আগে অভিযান চালিয়ে তাঁর দখলে থাকা জমি উদ্ধার করেছিল স্থানীয় প্রশাসন। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে গত ৫ আগস্ট বিকেলে তিনি আবার সেই জমি দখলে নেন।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ৫ আগস্ট বিকেলে সাহাব উদ্দিনের লোকজন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আবার ওই জমির দখল নেন। তখন তার অনুসারীরা স্থলবন্দর নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারদের জিনিসপত্র ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন। ওই মহলটি পর্যটনের উন্নয়নে নির্মিত সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ফেলে। পরে নির্মাণাধীন স্থলবন্দরের ৫২ দশমিক ৩০ একর জমি ছাড়া উভয় পাশের প্রায় ২০০ একর জমির দখল নেন সাহাব উদ্দিনসহ স্থানীয় কয়েকজন।

স্থানীয় প্রশাসন জানায়, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ভোলাগঞ্জে ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করে তৎকালীন সরকার। পাশাপাশি পর্যটনের উন্নয়নে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়। এ অবস্থায় দুই বছর আগে সরকারি জমি থেকে দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন। তবে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে আবার সে জায়গা দখল করা হয়।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, সরকারি জায়গা থেকে দখলকারদের উচ্ছেদে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। জায়গাটি নিয়ে মামলা ছিল। রায় সরকারের পক্ষে গেছে। দ্রুত রায় পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পশ্চিমে ১১২ একর ও পূর্বে প্রায় ১৫০ একর খাসজমি আছে। এসব জমির বেশির ভাগই অবৈধভাবে ভোগ দখল করে আসছিলেন বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিন। তবে সরকার সেখানে স্থলবন্দর নির্মাণ ও পর্যটনের উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে ২০২৩ সালে জায়গা দখলমুক্ত করে প্রশাসন। এরপর পশ্চিম অংশে স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৫২ দশমিক ৩০ একর জমি ইজারা নেয় বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। গত বছরের জুন মাসে স্থলবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু করে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের জুলাই মাসে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, স্থলবন্দর নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যখন জমি ইজারা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন সাহাব উদ্দিনের ব্যবস্থাপক হিসেবে পরিচিত নির্মল কুমার সিংহ ও তার ভাই উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন করেন। পরে আদালত সরকারের পক্ষে রায় দিলে জায়গাটি প্রায় ৮ কোটি টাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্থলবন্দর নির্মাণে ইজারা দেওয়া হয়।

অন্যদিকে সিলেট-ভোলাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পূর্ব অংশে ধলাই নদের পাড় পর্যন্ত প্রায় ১৫০ একর সরকারি খাসজমিতে স্থানীয় পর্যটনশিল্পের বিকাশে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে উন্নয়নকাজ শুরু করে। এ জন্য এসব জায়গা থেকে পাথর ভাঙার মেশিন অপসারণ করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও মাটি ভরাটের কাজ করা হয়।

সাহাব উদ্দিন দাবি করেন, একটি পক্ষ তাকে ঘায়েল করতে পেছনে লেগেছে। পক্ষটি ক্রমাগত মিথ্যাচার করছে। তিনি কোনো জমি দখল করে পাথর ব্যবসায়ীদের ভাড়া দেননি। পর্যটনকেন্দ্রিক উন্নয়নকাজ শুরুর আগে সেখানে তিন বিঘা জায়গায় তিনি পাথর রাখতেন। তবে যখন (২০২৩ সাল) সেখানে পর্যটনের উন্নয়নে কাজ শুরু হয়, তখন তিনিসহ অন্যদের প্রশাসন উচ্ছেদ করে। আর নির্মল কুমার সিংহ তার ব্যবস্থাপক নন।

সাহাব উদ্দিন বলেন, প্রশাসন উচ্ছেদ করার পর তিনি আর সেখানে পাথর রাখেননি। ৫ আগস্টের পর তিনি বা তার লোকজনের ওই জমি দখলের অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা।

স্থানীয় লোকজন জানান, ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের জন্য পশ্চিম অংশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জায়গা অধিগ্রহণ করার পর অতিরিক্ত প্রায় ৫৮ একর জায়গা উন্মুক্ত হিসেবে আছে। পাশাপাশি পূর্ব অংশে পর্যটনের উন্নয়নে ব্যবহৃত ১৫০ একর জমি ৫ আগস্টের পর বেদখল হয়ে যায়। এর মধ্যে সাহাব উদ্দিনের দখলেই সিংহভাগ জায়গা আছে বলে স্থানীয়ভাবে প্রচার আছে।

অভিযোগ আছে, সরকারি জমির দখল টিকিয়ে নিজের সাম্রাজ্য ঠিক রাখতে সাহাব উদ্দিন শুরু থেকেই স্থলবন্দর নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছেন। স্থলবন্দর নির্মিত হলে এলসির মাধ্যমে ভারত থেকে আনা কয়লা, চুনাপাথর ও পাথরে কর ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না-এটাও বিরোধিতার অন্যতম কারণ।

জানা যায়, গত ২৯ জানুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর একটি লিখিত আবেদন করে নির্মাণাধীন স্থলবন্দর স্থাপনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার অনুরোধ করেন সাহাব উদ্দিন। এ ছাড়া গত ২২ ফেব্রুয়ারি তার নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের ব্যানারে সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সাহাব উদ্দিন ওই গ্রুপের উত্তর সভাপতি। সংবাদ সম্মেলনে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর নির্মাণের বিরোধিতা করা হয়।

এদিকে ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে জায়গাটি দেখতে যান বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান। গত ২৬ ডিসেম্বর তিনি একটি প্রতিবেদনও প্রস্তুত করেন। কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি লিখেছেন, ৫ আগস্ট ও তৎপরবর্তী সময়ে স্থানীয় এক ব্যক্তির নেতৃত্বে সব স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই দিন ওই ব্যক্তির নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর নির্মাণে রাখা ঠিকাদারের সব যন্ত্রপাতিতে আগুন দেওয়া হয় এবং রক্ষিত মালামাল লুট করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বন্দরের উন্নয়নকাজ চলমান রাখা হয়েছে।

প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেও ওই ব্যক্তি উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন বলেন স্থলবন্দরের উন্নয়নকাজের সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে সাহাব উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ অংশে অপ্রয়োজনীয় সত্ত্বেও স্থলবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এটিসহ যৌক্তিক কিছু কারণেই স্থলবন্দর নির্মাণের বিরোধিতা তারা করছেন। তবে উন্নয়নকাজে তারা বাধা দিচ্ছেন না। স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। লুটপাট কিংবা জায়গা দখল-কোনো কাজেই তার সম্পৃক্ততা নেই।

সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। সুস্পষ্টভাবে সত্যতা পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।