চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ভোট গণনা চলছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ। বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে পুরো নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর ও স্বতঃস্ফূর্ত। ভোট গ্রহণ ব্যালট পেপারের মাধ্যমে হলেও গণনা করা হচ্ছে আধুনিক ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) পদ্ধতিতে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসজুড়ে বসানো হয়েছে ২৫০টি সিসি ক্যামেরা এবং ফলাফল সরাসরি দেখানোর জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৪টি এলইডি স্ক্রিন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। নির্বিঘœ ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করতে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন আছেন। রাত ৯টা পর্যন্তও ভোট গণনা শেষ হয়নি বলে জানা গেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আগ্রহী শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা এখন অধীর অপেক্ষায় আছেন চাকসু নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল জানার জন্য।

চাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। পৃথক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ তুলেছে শিবির ও ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলগুলো।শিবির সমর্থিত সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি অভিযোগ করেন, আইডি ভবনের ২১৪ নম্বর রুমে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছাড়াই ১০ থেকে ১৫টি ব্যালট বাক্স রাখা হয়েছে। বিষয়টি ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন বলেও দাবি করেন রনি।

রনি আরও বলেন, ভোটের সময় আলাউল হলে ছাত্রদলের প্রার্থী ও বহিরাগতদের দেখা গেছে, অথচ প্রশাসন তাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে এক ছাত্রী ভোট দিতে পারেননি এবং ভোট শেষে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মব তৈরি করে পরিবেশ অশান্ত করে তোলে। এছাড়া বিজ্ঞান অনুষদসহ কয়েকটি ভবনের এলইডি স্ক্রিন ঘন ঘন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তথ্যপ্রবাহ ব্যাহত হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন অভিযোগ করেন, ভোট গণনার আগমুহূর্তে শিবিরের বহিরাগত ক্যাডাররা তাদের কর্মীদের ওপর হামলার চেষ্টা চালিয়েছে। এতে সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। তিনি বলেন, “অনেক কেন্দ্রে ভোট গণনা শেষ হলেও বাইরে লাগানো এলইডি মনিটর বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে ফলাফল নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।” সাজ্জাদ জানিয়েছেন, ফল গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক অবস্থান জানানো হবে। উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে প্রশাসন জানিয়েছে, উভয় পক্ষের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

চাকসুর ভোট গণনা শুরু, সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ : নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয় বুধবার বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে। পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতিতে গণনা চলছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ডিন কার্যালয়ে ভোট গণনা চলছে। প্রতিটি ডিন কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা করা হবে। আর কেন্দ্রীয় সংসদের ফলাফল ঘোষণা করা হবে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সামনে।নির্বাচন কমিশনার আনোয়ার হোসেন জানান, ভোট গণনার পুরো প্রক্রিয়া সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. মনির উদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু পরিবেশে শেষ হয়েছে। কেন্দ্র থেকে ব্যালটগুলো পৃথক করে ডিন কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে ক্যামেরার সামনে ভোট গণনা করা হবে। ভোট গণনার স্ক্যানিং হবে ইমেজ আকারে। সেই ইমেজকে দুইটা প্যারালাল স্ক্যানিং করা হবে। নির্বাচনে দায়িত্ব প্রাপ্তরা ভোট গণনা করবেন, তাদের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সেলের প্রোগ্রামার আলাদাভাবে গণনা করবেন। দুটি মিলে গেলে ভোটের ফল প্রকাশ করা হবে।

ভোট দিলেন শিবির সমর্থিত ভিপি প্রার্থী ইব্রাহীম হোসেন : নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মো. ইব্রাহীম হোসেন রনি। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদ ভবন কেন্দ্রে তার ভোট দেন।

ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইব্রাহীম হোসেন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমরা অমোচনীয় কালি ব্যবহারের দাবি জানিয়েছিলাম, কিন্তু তা করা হয়নি। এতে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।” তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, “ ভোট গ্রহণ খুবই ধীরগতিতে চলছে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদে কয়েকটি ভোট পড়েছে বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে এসে ফিরে যাচ্ছে-এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কিছু হতে পারে না।”

ভোট দিয়েছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদ ভবন কেন্দ্রে তার ভোট প্রদান করেন। ভোট দেওয়ার পর সাজ্জাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “শিক্ষার্থীরা আমাদের যে রায় দেবেন, আমরা তা মেনে নেব। জয়-পরাজয় যাই হোক, অতীতের মতোই আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে থাকব। তবে যেভাবে ভোটগ্রহণ চলছে, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক।” তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, “ভোট শেষে একজন ভোটারের আঙুলে দাগ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেই দাগ সহজেই উঠে যাচ্ছে। এতে একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কেন এমনটা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা আমরা চাই।”

প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে: প্রধান নির্বাচন কমিশনার : চাকসু নির্বাচনে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে প্রথম আলোকে তিনি এ তথ্য জানান।অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, “এখনো পর্যন্ত সব কেন্দ্রের তথ্য আমাদের কাছে আসেনি। তবে সার্বিকভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন। সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ভোটগ্রহণ হয়েছে ৬৭.১৭ শতাংশ, আইটি ভবনে ৭২ শতাংশ এবং বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ৬৯ শতাংশ ভোটারের।” সাড়ে চার ঘণ্টায় ভোট ৪০ শতাংশ : চাকসু নির্বাচনে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এই সময়ে ভোট দিয়েছেন প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী। নির্বাচন কমিশনার জি এইচ হাবীব এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ চলে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ : ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত চাকসু নির্বাচনে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। একসময় পুরো ক্যাম্পাসে দাপট দেখানো এ সংগঠনকে এবারের নির্বাচনি উৎসবে কোথাও দেখা যায়নি। ২৪ জুলাইয়ের বিপ্লবের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। কথিত ছিল- তাদের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে গাছের পাতাও নড়ত না। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এবারের নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বসিতভাবে ভোট দিলেও ছাত্রলীগকে ঘিরে কোনো আলোচনা বা আগ্রহ চোখে পড়েনি।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের আমলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের কর্মসূচিতে টেনে নিয়ে যেত ছাত্রলীগ। তবে জুলাই বিপ্লবের পর পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন। বিজ্ঞান অনুষদ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা খালেদা জিয়া হলের শিক্ষার্থী তাসলিমা জান্নাত বলেন, “ছাত্রলীগের পতনের পর আমরা মুক্তি পেয়েছি। তাই এত বড় আয়োজনে কেউ তাদের মিস করছে না।

চাকসুতে এবার মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৬ জন। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় পাঁচটি অনুষদে, ১৫টি হলের জন্য নির্ধারিত ১৫টি কেন্দ্রে। মোট ৬০টি কক্ষে ৬৮৯টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট ৯০৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ১৩ টি প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে ৪১৫ জন এবং হল ও হোস্টেল সংসদে ৪৯৩ জন।