নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনেও বিশাল জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট। ২৬টি পদের মধ্যে এই প্যানেলের প্রার্থীরা ভিপি (সহসভাপতি)-জিএস (সাধারণ সম্পাদক) সহ ২৪টি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে সাড়ে ৪৪ বছর পর চাকসুতে প্রত্যাবর্তন হচ্ছে ছাত্রশিবিরের। এরআগে চাকসুর ইতিহাসে ছাত্রশিবিরের সর্বশেষ জয় এসেছিল ১৯৮১ সালে।

অন্যদিকে ফলাফল ঘোষণার শুরুতে আশা জাগালেও শেষ পর্যন্ত বিশাল ব্যবধানে ভরাডুবি হয়েছে ছাত্রদলের। ছাত্রদল কখনোই চাকসুর শীর্ষ পদগুলো নিজেদের দখলে নিতে পারেনি। এবারও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটায় সপ্তম চাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এতে ভিপি পদে ছাত্রশিবিরের মো. ইব্রাহিম হোসেন ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সংগঠনটির চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও ইতিহাস বিভাগের এমফিলের শিক্ষার্থী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের সাজ্জাদ হোসেন পেয়েছেন ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট।

জিএস পদে ৮ হাজার ৩১ ভে টে নির্বাচিত হয়েছেন একই প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক ও ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মো. শাফায়াত পেয়েছেন ২ হাজার ৭৩৪ ভোট।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন ফলাফল ঘোষণার সময় বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। প্রার্থী ও ভোটাররা নির্বাচনে অসাধারণ উৎসবমুখর অংশগ্রহণ করেছেন।

চাকসুতে ২৬টি পদে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি পদে নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রদলের প্যানেলের প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক। তিনি এজিএস পদে পেয়েছেন ৭ হাজার ১৪ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রশিবির প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৫ ভোট। এ ছাড়া সহ খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে জিতেছেন তামান্না মাহবুব নামের এক স্বতন্ত্র প্রার্থী। চাকসুর মোট ২১টি সম্পাদকীয় পদের ১৯টিতেই জিতেছে ছাত্রশিবির। পাঁচটি নির্বাহী সদস্য পদের সবগুলোতে তারা জয় পেয়েছে।

এ ছাড়া পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে মাসুম বিল্লাহ, আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক পদে ফজলে রাব্বি তৌহিদ, যোগাযোগ ও আবাসন বিষয়ক সম্পাদক পদে ইসহাক ভূঁঞা, সহ যোগাযোগ আবাসন বিষয়ক সম্পাদক পদে ওবায়দুল ইসলাম, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে মেহেদী হাসান সোহান, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক পদে মোনায়েম শরীফ, স্বাস্থ্য সম্পাদক বিষয়ক সম্পাদক পদে আফনান হাসান ইমরান, সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদে তাহসিনা রহমান, গবেষণা ও উদ্ভাবন বিষয়ক সম্পাদক পদে তানভীর আঞ্জুম শোভন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদে মাহবুবুর রহমান, ছাত্রীকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক পদে নাহিমা আক্তার দ্বীপা, সহ-ছাত্রী কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক পদে জান্নাতুল ফেরদৌস রিতা, দফতর সম্পাদক পদে আব্দুল্লাহ আল নোমান, সহ-দফতর বিষয়ক সম্পাদক পদে জান্নাতুল আদন নুসরাত, সাহিত্য সংস্কৃতি ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক পদে হারেজুল ইসলাম, সহ-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক পদে জিহাদ হোসাইন, খেলাধুলা ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক পদে মোহাম্মদ শাওন বিজয়ী হয়েছেন।

নির্বাহী সদস্য পদে জান্নাতুল ফেরদাউস সানজিদা, সালমান শাকিব, আকাশ দাশ, আদনান শরীফ ও সোহানুর রহমান সোহান নির্বাচিত হয়েছেন। ১৫ অক্টোবর (বুধবার) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত একটানা চাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়। ভোটগ্রহণের সময় বড় ধরনের কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি।

গণনা শেষে ভোর ৫টার দিকে বাণিজ্য অনুষদ মিলনায়তনে সর্বশেষ ফলাফল ঘোষণা করে চাকসু প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন জানিয়েছেন, নির্বাচনে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন।

এর আগে ১৯৮১ সালে ছাত্রশিবির একবার চাকসুতে পূর্ণ প্যানেলে জয় পেয়েছিল। এর ৪৫ বছরের মাথায় তারা আবার চাকসুর দখল নিল। আর ছাত্রদল কখনোই চাকসুর শীর্ষ পদগুলো নিজেদের দখলে নিতে পারেনি। এবারও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে।

বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে ছাড়া প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে চাকসু নির্বাচন। ১৯৯০ সালে সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৯০ পর্যন্ত মোট ছয়টি নির্বাচন হয়েছিল। এতে একবার ছাড়া ঘুরেফিরে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থীরা জয় পেয়েছিল।

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭০ সালের প্রথম চাকসু নির্বাচনে ভিপি (সভাপতি) নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং জিএস হন ছাত্রলীগের আবদুর রব। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন চাকসু জিএস আবদুর রব।

১৯৭২ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা ভিপি এবং জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না জিএস নির্বাচিত হন।

১৯৭৪ সালের তৃতীয় নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের এস এম ফজলুল হক, আর জিএস হন গোলাম জিলানী চৌধুরী। ১৯৭৯ সালের চতুর্থ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী এবং জিএস হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী।

১৯৮১ সালের পঞ্চম নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জসিম উদ্দিন সরকার, জিএস হন একই সংগঠনের আবদুল গাফফার।

১৯৯০ সালের ষষ্ঠ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী জাতীয় ছাত্রলীগের নাজিম উদ্দিন এবং জিএস হন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ।

তবে ওই বছরের ডিসেম্বরে সংঘর্ষে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা ফারুকুজ্জামান নিহত হলে চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ৩৫ বছর কোনো নির্বাচন হয়নি। ২০২৫ সালের সপ্তম নির্বাচনে দীর্ঘ সাড়ে ৪৪ বছর পর ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্রার্থীরা আবারও চাকসুর নেতৃত্বে ফিরেছেন।

চাকসু নির্বাচনে এবার ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ১৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩২৯ জন। শিক্ষার্থীদের ভোটে এক বছরের জন্য গঠিত হবে ২৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় সংসদ। একই মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি আবাসিক হল ও একটি হোস্টেলেও সংসদ গঠন হবে। এছাড়া চাকসু মনোনীত পাঁচ শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামÑ সিনেটে অন্তর্ভুক্ত হবেন।