* ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদ ও প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. এস কে শরীফুল আলম পদত্যাগ করেছেন। বুধবার (২৩ এপ্রিল) রাতে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে কুয়েট ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদ এবং প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. শেখ শরীফুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার মত পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানান কুয়েটের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. শেখ শরীফুল আলম।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরও যখন বিষয়টি সুরাহা হচ্ছিল না, তখন দু’জন পদত্যাগের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। এরপর তারা পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।

নিয়ম অনুযায়ী তাদের পদত্যাগপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। তিনি অনুমোদন করলে পদত্যাগ কার্যকর হবে।

এর আগে বুধবার দিবাগত রাতে মন্ত্রণালয় জানায়, কুয়েটে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে উদ্ভূত সংকট নিরসন এবং শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রো-ভিসিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

অনতিবিলম্বে একটি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ দুটি পদে নতুন নিয়োগ প্রদান করা হবে। অন্তর্বর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকগণের মধ্য থেকে একজনকে সাময়িকভাবে ভিসির দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এদিকে কুয়েট ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদ এবং প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. শেখ শরীফুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার মত পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানিয়েছেন কুয়েটের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. শেখ শরীফুল আলম।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. শেখ শরীফুল আলম শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে দাবি সম্বলিত একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে তিনি অব্যাহতি দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার রাখি। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর আমাকে কুয়েটের প্রো-ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রো-ভিসি পদে যোগদানের পর বিভিন্ন দাপ্তরিক সভা ও সিন্ডিকেটে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। যোগদানের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আমাকে কোন প্রশাসনিক ও আর্থিক কাজে সহযোগিতা করেননি। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রো-ভিসির সীমিত আকারে প্রশাসনিক ও আর্থিক কাজ করার যে নীতিমালা ছিল তা গত ১১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭-তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে বাতিল করে দেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে গত ৪ মাসে প্রশাসনিক কার্যাদি এবং আর্থিক বিলে স্বাক্ষর করতে না দিয়ে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি পদটি একটি অলংকারিক পদে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি হিসেবে আমি শুধুমাত্র লাইব্রেরী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব¡ পালন করি।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে সর্বদা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করেছি। এ অবস্থায় গত রাতে প্রিন্ট/ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মারফত জানতে পারি সরকারের তরফে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাস্তবতা হলো আমি নিজে এখনও আমার অপরাধ সম্পর্কে জানি না এবং আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেয়া হয়নি যা খুবই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়া এবং কোন অপরাধ/অপকর্ম না করে অব্যাহতি দেয়ার মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুল বার্তা যাবে বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসিকে অব্যাহতি দেয়ার মত পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি বা অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

আমি পদত্যাগ করিনি : কুয়েটের প্রো-ভিসি : কুয়েট প্রো-ভিসি শেখ শরীফুল আলম বলেছেন, আমি গতকাল (বুধবার) দিবাগত রাত ১০টায় ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছি। তবে কোন কাগজে স্বাক্ষর করিনি। এটা অব্যাহতি হতে পারে। কিন্তু আমি পদত্যাগ করিনি বা আমাকে পদত্যাগ করতে বলাও হয়নি। পদত্যাগের বিষয়ে জানতে ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তিনি বলেন, ইউজিসির টিম বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন। বেশিরভাগ সময় ছাত্রদের সাথে কথা বলেছেন। আমার সাথে কথা বলেছেন বিকেল সাড়ে ৪ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। ১৮ ও ১৯ তারিখের ঘটনা বিষয়ে কথা হয়েছে। তাদের কোন প্রশ্নই আমার কাছে মনে হয়নি যে আমার কোন একটা জায়গা থেকে ত্রুটি বা স্বচ্ছতা, নিষ্ঠার অভাব আছে। প্রতিষ্ঠান বা ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করছি। তবে আমি বুঝতেই পারছি না যে আসলে আমার অপরাধটা কী ?

ভিসি ও প্রো-ভিসিকে অব্যাহতির সিদ্ধান্তে ন্যায়বিচারের পরাজয় হয়েছে-শিক্ষক সমিতি : সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া চাপের মুখে ভিসি ও প্রো-ভিসির অব্যাহতির সিদ্ধান্তে ন্যায়বিচারের পরাজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে কুয়েট শিক্ষক সমিতি। গতকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. সাহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. ফারুক হোসেন এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম একটা রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। কিন্তু বর্তমান সময়ে যারা রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের আন্দোলন করে আসছিল, আমরা দেখতে পাচ্ছি তারাই আজ অন্ধকার রাজনীতির করালগ্রাসে বন্দী। এ কারণে ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে উদ্ভূত সংকট নিরসনে শিক্ষকদের কোনো চেষ্টায় সফল হয়নি।’ তারা বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টাসহ তাঁর পাঠানো প্রতিনিধিদলও এক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। ফলে সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া চাপের মুখে ভিসি ও প্রো-ভিসির অব্যহতির সিদ্ধান্তে মূলত ন্যায়বিচারের পরাজয় হয়েছে।

এদিকে কুয়েট ভিসি পদত্যাগের দাবি মেনে নেয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটায় ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের হাতে জাতীয় পতাকা ও ফিলিস্তিনের পতাকা শোভা পাচ্ছিলো। এসময় বিজয় মিছিলে শিক্ষার্থীরা স্লোগানে বলেন, ‘রাজনীতির আস্তানা, কুয়েটে হবে না’, ‘শিক্ষা-সন্ত্রাস একসঙ্গে চলে না’। স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে থেকে মিছিলটি বের হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ শেষে শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে শেষ হয়।

এর আগে বুধবার (২৩ এপ্রিল) দিবাগত রাতে কুয়েটের ভিসি-প্রোভিসির পদত্যাগের খবরে অনশনরত শিক্ষার্থীদের রাত একটায় জুস খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দিন খান। গত ২১ এপ্রিল বিকেল তিনটা থেকে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। অনশনের তৃতীয় দিন বুধবার সকালে শিক্ষা উপদেষ্টা ও ইউজিসি সদস্যরা অনশনস্থল পরিদর্শন করেন। দিনভর ইউজিসির দু’জন প্রতিনিধি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একজন যুগ্মসচিব বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলেন। রাতে সরকারের পক্ষ থেকে ভিসি-প্রোভিসি উভয়কে অব্যাহতি দেওয়ার খবর আসে। সর্বশেষ জানা যায় তারা দু’জনই পদত্যাগ করেছেন। এরপর ইউজিসি সদস্য অনশনকারীদের জুস খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করালে শিক্ষার্থীরা অনশন ছেড়ে তাৎক্ষনিক বিজয় মিছিল করেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকেলে চূড়ান্ত বিজয় মিছিলের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রায় দুই মাসের আন্দোলনের ইতি ঘটে।

উল্লেখ্য, গত ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি কুয়েটের সৃষ্ট ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবিনামা দেওয়া হয়। ওই দাবি বাস্তবায়ন না হলে তারা ভিসির পদত্যাগের একদফা ঘোষণা করেন। যার আলোকে সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে গত ১৩ এপ্রিল তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে দু’দিন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয়ার পর ১৫ এপ্রিল ছয়টি হলের তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করেন। সর্বশেষ ভিসির পদত্যাগ না হলে তারা আমরণ অনশনের ঘোষণা দেন। যার আলোকে ২১ এপ্রিল বিকেল তিনটা থেকে কুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিষদ চত্বরে তারা অনশন শুরু করেন। যেটি শেষ হয় (২৩ এপ্রিল) দিবাগত রাত একটায়।