দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আজ (১৫ অক্টোবর) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় এখন এক ঐতিহাসিক নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। ভোটগ্রহণকে ঘিরে প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম পৌঁছে দিয়েছে চাকসু নির্বাচন কমিশন। এদিকে নির্বাচন কেন্দ্র করে পুরো ক্যাম্পাসে নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হবে বুধবার সকাল ৯টা থেকে যা চলবে টানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ২৫ হাজার ৫২১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্র ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ১১ হাজার ৩২৯ জন।
চাকসু নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলে মোট ৯০৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদে ৪১৫ জন এবং হল সংসদের ১৪টি পদে ৪৯৩ জন প্রার্থী লড়ছেন। ভিপি পদে ২৪ জন, জিএস পদে ২২ জন এবং এজিএস পদে ২১ জন প্রার্থী প্রার্থিতা করছেন।চাকসু নির্বাচনের সব প্রস্তুতি মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকালেই সম্পন্ন হয়। সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করে নির্বাচন কমিশন। দুপুর ১২টার মধ্যেই সব কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মঙ্গলবার সকালে চাকসু ভবনের সামনে পিকআপ ভ্যানে করে ব্যালট বাক্স আনা হয়। সেখান থেকে সেগুলো পাঁচটি অনুষদ ভবনে পাঠানো হয়- কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ ও প্রকৌশল অনুষদ। এই পাঁচ ভবনের মোট ৬০টি কক্ষে প্রায় ৭০০ বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য চাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলায় বিশেষ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখানে শুধুমাত্র দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা দুইজন নির্বাচন কমিশনারের তত্ত্বাবধানে ভোট দিতে পারবেন। চাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন জানান, “ব্যালট বাক্স ইতোমধ্যে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে ভোটকক্ষ প্রস্তুতের কাজ চলছে। বুধবার ভোট শুরুর আগে সকালে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেওয়া হবে।”
নির্বাচন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা ওএমআর ব্যালট শিটে ভোট প্রদান করবেন। চাকসু নির্বাচনের জন্য চার পৃষ্ঠার ব্যালট শিট ব্যবহার করা হবে। আর হল ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচনের জন্য থাকবে এক পৃষ্ঠার ব্যালট শিট।
ভোটগ্রহণ ও কেন্দ্র : ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ অনুষদ ভবনে— ব্যবসায় প্রশাসন, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনে। মোট ১৫টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে। এর মধ্যে ১৪টিতে হল সংসদ এবং ১টিতে হোস্টেল সংসদের নির্বাচন হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য চাকসু ভবনে আলাদা ভোটকেন্দ্র রাখা হয়েছে।
মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৮ জন, এর মধ্যে ১৬ হাজার ১৮৯ জন পুরুষ এবং ১১ হাজার ৩২৯ জন নারী। প্রকৌশল অনুষদে ভোটার ৪,০৩৬ জন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনে ৫,২৬৩ জন, বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ৪,৫৩৮ জন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ৬,৬০৬ জন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবনে ৭,০৭৩ জন ভোটার ভোট দেবেন।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা : ভোট ঘিরে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রক্টরিয়াল টিমের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও আনসার সদস্য। প্রতিটি কেন্দ্রে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। বহিরাগত প্রবেশে থাকবে কড়া নজরদারি।নির্বাচনকে ঘিরে পুরো ক্যাম্পাসে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নির্বাচনী পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় এক হাজার সদস্য। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরা টহলে রয়েছেন। প্রতিটি অনুষদ ভবনে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন এবং মোবাইল কোর্টও পরিচালিত হবে। র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “ক্যাম্পাসে পুলিশ ও র্যাব মিলিয়ে এক হাজারের মতো ফোর্স মোতায়েন আছে। র্যাবের ৮টি টিম টহলে রয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ এখন সুন্দর ও স্বাভাবিক। আমরা আশা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন জানান, “শান্তিপূর্ণভাবে ভোট সম্পন্ন করতে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বুথে সর্বোচ্চ ৫০০ শিক্ষার্থীর ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি এবং হল সংসদের ১৪টি- মোট ৪০টি ভোট দিতে পারবেন।”
প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা : মোট ৯০৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদে ৪১৫ জন প্রার্থী, এর মধ্যে ভিপি পদে ২৪, জিএস পদে ২২ এবং এজিএস পদে ২১ জন। এছাড়া অন্যান্য সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক পদে ২০ থেকে ৮৫ জন পর্যন্ত প্রার্থী রয়েছেন।
হল সংসদের ১৪টি পদে মোট ৪৭৩ জন প্রার্থী লড়ছেন, এর মধ্যে ছাত্রদের ১০টি আবাসিক ইউনিটে ৩৫০ জন এবং ছাত্রীদের ৫টি হলে ১২৩ জন প্রার্থী।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা : দীর্ঘ বিরতির পর নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রাফি আহমেদ বলেন, “আমরা ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছি। প্রথমবার ভোট দিতে পারব— এটা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।”
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা রহমান বলেন, “চাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সমস্যার প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব হবে বলে আমরা আশাবাদী।”
চাকসুর ইতিহাস : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) গঠিত হয় ১৯৬৬ সালে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা ও নেতৃত্ব বিকাশের লক্ষ্যে। সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক জটিলতায় দীর্ঘ ৩৫ বছর নির্বাচন বন্ধ থাকে। ২০২৫ সালের এই নির্বাচন শুধু নেতৃত্ব নির্বাচন নয়, বরং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)-এর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। পরবর্তীতে ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে নির্বাচন হয়। সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে আর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।