দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ‘শাটডাউন’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস-পরীক্ষা চলবে না। রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে চলমান অবস্থান কর্মসূচিতে গতকাল বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রইছ উদ্দীন এ ঘোষণা দেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বেলা দুইটার দিকে এই শিক্ষক বলেন, আমাদের অধিকার চাইতে, আমাদের দাবি আদায়ের জন্য এসেছি। দাবি আদায় না করে আমরা ঘরে ফিরব না।

অধ্যাপক রইছ উদ্দীন বলেন, আমরা কারও বিরুদ্ধে এখানে কথা বলতে আসিনি; কোনো ষড়যন্ত্র করতে আসেনি। আমরা এখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায্য অধিকার নিয়ে এসেছি। আমাদের ওপর পুলিশ নির্বিচার হামলা চালিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অরাজকতা এবং অন্যায়। এখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা ভালো হবে না বলে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে কোনো শিক্ষার্থীকে কেউ আঘাত করতে পারবে না। এর আগে বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ইনস্টিটিউট ও বিভাগের পরীক্ষা অনিবার্য কারণবশত স্থগিত করা হলো।

এদিকে পুলিশের হামলার বিচার ও তিন দফা দাবিতে গতকালও কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত ২৪টি বাস কাকরাইল মোড়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসব বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তারা আন্দোলনস্থলে যান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসনবৃত্তি ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করার তিন দফা দাবিতে কিছুদিন ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচির অংশ হিসেবে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্য চত্বরের সামনে থেকে লংমার্চ শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লংমার্চ কাকরাইল মসজিদের সামনে পৌঁছালে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় আন্দোলনকারীরা পুলিশের দেওয়া ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। একপর্যায়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। এ সময় প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হন বলে আন্দোলনকারীরা জানান। পরে বেলা দুইটার দিকে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকেল চারটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বাসে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কয়েক শ শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

রাত ১০টার পর অবস্থান কর্মসূচিতে আসেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এ সময় তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুতই প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করবেন। বৈঠকে শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির বিষয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনের বিষয়ে সরকার কথা শুনবে। তবে রাত ১২টার পর আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সদস্যসচিব শামসুল আরেফিন। তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা (মাহফুজ আলম) যে ব্রিফিং করেছেন, সেটি আরেকটি অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া আমরা কোনোভাবেই এই জায়গা ছেড়ে যাব না।’

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শরিক হতে একের পর এক বাস নিয়ে আসছেন সতীর্থরা। কাকরাইলে চলা এ আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে অংশ নিয়েছেন বিপুল সংখ্যক শিক্ষকও। বুধবার রাতভর সড়কে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমবেত হতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৩০টি একতলা ও দোতলা বাস যোগে শিক্ষার্থীরা এসেছেন। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে আন্দোলনে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থী আবুল হাসনাত বলেন, আমরা গতকাল (বুধবার) সারাদিন আন্দোলন করে রাতে ফ্রেশ হওয়ার জন্য অনেকেই বাসায় আসি। কিন্তু আমাদের ভাই-বোনরা না খেয়ে টানা ২৪ ঘণ্টা আন্দোলন করছে; আর আমরা বাসায় বসে তো থাকতে পারি না। তাই তাদের সাথে যোগ দিতে আমরা আবার এসেছি। এই আগে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রইছ উদদীন ফেইসবুক লাইভে এসে আন্দোলনে যোগ দিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে শিক্ষকদের অন্তত পাঁচটি বাস আন্দোলনস্থলে এসেছে। ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির আহমেদ বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শত শত শিক্ষকরাও আন্দোলনে যোগদান করছে। অনেকেই শিক্ষার্থীদের সাথে সড়কে রাত্রিযাপন করেছেন। যত সময় যাবে, আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়বে। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে- যত দ্রুত সম্ভব অবহেলিত জবি শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস না আসা পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন আন্দোলনকারীরা। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের এলাকায় তারা দাবি আদায়ে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন।

এর মধ্যে রয়েছে- ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘তুমি কে আমি কে, জবিয়ান জবিয়ান’, ‘ভুজুংভাজুং বুঝি না, লংমার্চ টু যমুনা’, ‘রক্ত লাগলে রক্ত দে, তবু আমাদের আবাসন দে’, ‘জ্বালো রে জ্বালো. আগুন জ্বালো’, ‘আর নয় হেলাফেলা, এবার হবে আসল খেলা’, ‘বৈষম্যের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘জবিয়ান আসছে, রাজপথ কাঁপছে’, ‘শিক্ষকদের অপমান, সইবে নারে জবিয়ান’, ‘আমার ভাই আহত কেন, ইন্টেরিম জবাব দে’সহ নানা স্লোগান।

তিন দফা দাবিতে এ আন্দোলন শুরু হয়। এগুলো হলো-

১. আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে আবাসন বৃত্তি কার্যকর করতে হবে;

২. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করতে হবে;

৩. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করতে হবে। ‘পুলিশি হামলার’ অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার আরেকটি দাবি যুক্ত করেন আন্দোলনকারীরা। তাদের নতুন দাবি হলো, বুধবার শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত দিতে হবে। প্রথম তিনটি দাবি নিয়ে বুধবার দুপুরে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাস থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও দপ্তর যমুনা অভিমুখে ‘লং মার্চ’ শুরু করেন।

মিছিলটি গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজার, জিরো পয়েন্ট, সচিবালয়, শিক্ষা ভবন, হাই কোর্ট ও মৎস্য ভবন মোড়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়লেও তা উপেক্ষা করে কাকরাইল মসজিদের সামনে আসে। একপর্যায়ে মিছিলটি প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে এলে সেখানে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যমুনায় যান। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ ওঠে। এ পরিস্থিতিতে রাত ৮টা থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা কাকরাইল মসজিদ মোড় ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে আসছেন।