জাকসু নির্বাচনে জয়ের পর মহান রবের প্রতি শুকরিয়ার সেজদা দিয়েছেন শিবির প্যানেল থেকে জয়ী প্রার্থীরা। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তারা এই কর্মসূচি পালন করেন। এদিকে সব দল ও মতকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইনক্লুসিভ’ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে চান বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) নবনির্বাচিত সহসভাপতি (ভিপি) আবদুর রশিদ জিতু। অন্যদিকে ভিপি নিজেদের প্যানেলের বাইরে থেকে নির্বাচিত হলেও সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে চান ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) মাজহারুল ইসলাম।

দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলো। নব নির্বাচিত ভিপি আবদুর রশিদ জিতু বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনের পর জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সে অধিকার ফিরে পেয়েছি। জাকসুর নেতা বা ভিপি হওয়া আমাদের কখনোই ইচ্ছা ছিল না। আমাদের ইচ্ছা ছিল শিক্ষার্থীরা যে অধিকার থেকে দীর্ঘ ৩৩ বছর বঞ্চিত ছিল, সে অধিকার ফিরিয়ে আনা।

নির্বাচনে ছাত্রশিবির প্যানেল থেকে বেশি প্রার্থী জয়লাভ করেছেন উল্লেখ করে নবনির্বাচিত ভিপি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের প্রথম কাজ হবে সকল দল, মত সাথে নিয়ে একটি ইনক্লুসিভ জাহাঙ্গীরনগর গড়ে তোলা। আমরা যে ইশতেহার দিয়েছিলাম, সেটি এমন কোনো অলৌকিক ইশতেহার নয়, যেটি বাস্তবায়ন করতে পারব না।

জাকসুর নবনির্বাচিত জিএস মাজহারুল ইসলাম বলেছেন, নবনির্বাচিত ভিপি আমাদের প্যানেলের বাইরে থেকে নির্বাচিত হলেও আমরা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। আমাদের প্রথম কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই আন্দোলনে ছাত্রলীগ যে হামলা চালিয়েছিল, ওই হামলায় যেসব শিক্ষক জড়িত ছিলেন তাঁদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবহন সমস্যা রয়েছে, সেটি সমাধান করা।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে একটি সুন্দর, নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে চান উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের দপ্তর ও প্রকাশনা সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করে গড়ে তোলার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, আমরা সবকিছু বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাব।

নবনির্বাচিত এই জিএস বলেন, ‘নির্বাচনে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট প্রদান করেছেন। সকল প্রার্থী এবং শিক্ষার্থী এই নির্বাচন মেনে নিয়েছেন এবং সুষ্ঠুভাবে ভোট গণনা সম্পন্ন হয়েছে। সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট শিক্ষার্থীদের কাছে যে অঙ্গীকার করেছে এবং শিক্ষার্থীরা যে বিশ্বাস নিয়ে আমাদের নির্বাচিত করেছেন, আমরা সে অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে দায়বদ্ধ।

নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে বিজয়ী ছাত্রশিবিরের বর্তমান কমিটির দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৩০ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরামের আবু তৌহিদ মো. সিয়াম পেয়েছেন ১ হাজার ২৩৮ ভোট। মাজহারুল বিএনসিসির বিশ্ববিদ্যালয় প্লাটুনের সার্জেন্ট, ক্যাডেট আন্ডার অফিসার (সিইউও) ও ইনচার্জ ছিলেন। পাশাপাশি তিনি বিতর্ক সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট অর্গানাইজেশন (জেইউডিও) ও জাবি প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন।

এজিএস (পুরুষ) ফেরদৌস আল হাসান পেয়েছেন ২ হাজার ৩৫৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরামের জিয়া উদ্দিন আয়ান পেয়েছেন ২ হাজার ১৪ ভোট। ফেরদৌস রোভার স্কাউটের সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র রোভার মেট। এজিএস (নারী) আয়েশা সিদ্দিকা (মেঘলা) পেয়েছেন ৩ হাজার ৪০২ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরামের মালিহা নামলাহ পেয়েছেন ১ হাজার ৮৩৬ ভোট। মেঘলা জাবি প্রেসক্লাবের সাবেক সহসভাপতি ও ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের সদস্য। এ ছাড়া নির্বাচনে শিবিরের প্যানেলে প্রার্থীদের অধিকাংশ একাধিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের নিজস্ব ভোটব্যাংক ছিল।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাধারণ সম্পাদক (জিএস), এজিএস (পুরুষ) ও এজিএস (নারী) পদের বাইরে শিবিরের প্যানেলে নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্যে দেড় হাজারের ওপরে ভোট পেয়েছেন ছয়জন, দুই হাজারের ওপরে ভোট পেয়েছেন পাঁচজন, আড়াই হাজারের ওপরে ভোট পেয়েছেন চারজন ও তিন হাজারের ওপরে ভোট পেয়েছেন দুজন। এদিক থেকে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের দেড় হাজারের ওপরে ‘ভোটব্যাংক’ আছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে শিবির সক্রিয় হওয়ার পর তাদের কোনো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়াতে দেখিনি। এ কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তাদের ভোট দিয়েছেন। শিবির যদি নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলে, তাহলে কারও কোনো সমস্যা নেই।

জাকসু নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে বিজয়ী হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা। তারা জাকসুর ২৫টি পদের মধ্যে জিএস-এজিএস ছাড়াও ২০টি পদে জয় পেয়েছেন। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্যানেল থেকে ভিপি পদ এবং দুটি করে পদে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।

ফাইয়াজের স্ট্যাটাস :

জাকসুর জিএস মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে জুলাই আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা ও তারই ভাই হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজ একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লিখেছেনÑ‘আম্মুর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আজ জাকসুর জিএস। ভাইয়ের এ অর্জনে উচ্ছ্বসিত ফাইয়াজ নিজের ফেসবুক পেজে লেখেনÑএকদিন আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আম্মু, আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? কোনো দ্বিধা না করে তিনি বলেছিলেন, ‘ফাহিম’। সেই আম্মুর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আজ জাকসুর জিএস নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

ফাইয়াজ বিশ্বাস করেন-তার ভাই শিক্ষার্থীদের জন্য শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা, অধিকার রক্ষায় আপসহীন ভূমিকা এবং মতামতের বৈচিত্র্যকে অগ্রাধিকার দেবেন। ফাইয়াজ উল্লেখ করেনÑমাজহারুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিএনসিসি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি প্লাটুনের সিইউও ও ক্যাডেট ইনচার্জ, বিতর্ক সংগঠন জেইউডিওর সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন সামাজিক ও অ্যাকাডেমিক প্ল্যাটফর্মে দায়িত্ব পালন করেছেন। জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে ফাইয়াজ লেখেন,‘ভাইয়া সেই সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আমাকে টর্চার করে ভাইয়ার লোকেশন জানতে চেয়েছিল। আমার কাছ থেকে না পেয়ে তারা ভাইয়ার মোবাইল ট্র্যাক করেছিল, কিন্তু কৌশলী হওয়ায় ভাইয়াকে ধরতে পারেনি। পোস্টে আরো লেখা ছিলÑ‘সবাই দোয়া করবেন, আমার আম্মুর সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে যেন জাকসুতেও শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। আল্লাহ যেন ভাইয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কবুল করেন।

এদিকে জুলাই আন্দোলনের সময়ে ফাইয়াজের এক ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। প্রিজনভ্যান থেকে নামানো এক কিশোর, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সি গায়ে, দুই হাত সাদা রশিতে বাঁধা, হাতে কাপড়ের ব্যাগ। ছবির সেই কিশোর হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজ তখন ছিলেন মাত্র ১৭ বছরের, ঢাকা কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ফাইয়াজ তিন ভাইয়ের মেজ। বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম (ডাক নাম ফাহিম) এবার জাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচিত হন।

হলগুলোতে ভিপি জিএস যারা :

আল বেরুনী হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হলেন রিফাত আহমেদ শাকিল। জিএস হয়েছেন মুনতাসির বিল্লাহ খান। এজিএস সাদমান হাসান খান। কামাল উদ্দিন হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন জিএমএম রায়হান কবীর। জিএস নির্বাচিত হয়েছেন আবরার শাহরিয়ার। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন রিপন মন্ডল (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। নজরুল ইসলাম হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন রাকিবুল ইসলাম। জিএস নির্বাচিত হয়েছেন আলী আহমেদ। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন সামিন ইয়াসির। মীর মশাররফ হোসেন হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন খালেদ জুবায়ের। জিএস নির্বাচিত হয়েছেন শাহরিয়ার নাজিম। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন আরাফাত হোসেন। মওলানা ভাসানী হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন আবদুল হাই স্বপন। জিএস নির্বাচিত হয়েছেন হৃদয় পোদ্দার। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন রাকিব হাসান। সালাম- বরকত হল: ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন মারুফ হোসেন। জিএস হয়েছেন মাসুদ রানা, এজিএস আবরার আজিম ভুঁইয়া। নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন বুবলী আহমেদ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। জিএস হয়েছে সুমাইয়া খানম (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা), এজিএস প্রার্থী নেই।

১০ নং (ছাত্র) হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন আসিফ মিয়া। জিএস নির্বাচিত হয়েছেন মেহেদী হাসান। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন নাদিম মাহমুদ।১৫ নং (ছাত্রী) হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন শারমীন খাতুন (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। জিএস মেহনাজ মোহনা। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন শাহানা আক্তার। তারামন বিবি হল: ভিপি পদে ফারজানা আক্তার ঊর্মি ও জিএস পদে প্রিয়াঙ্কা কর্মকার জয়লাভ করেছেন। রোকেয়া হল: ভিপি পদে তাফমিম খানম ও জিএস পদে নাবিলা মাহজাবিন জয়লাভ করেছেন। ২১ নং ছাত্র হল: ভিপি পদে শিহাব ও জিএস পদে অলি উল্লাহ জয়লাভ করেছেন। রফিক জব্বার হল: ভিপি মেহেদী হাসান ও জিএস শরিফুল ইসলাম জয় পেয়েছেন। ফজিলতুন্নেসা হল: ভিপি পদে ঐশী সরকার (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা) এবং জিএস নির্বাচিত হয়েছেন ফারজানা তাবাসসুম। তাজউদ্দীন হল: ভিপি পদে সিফাত উল্লাহ এবং জিএস হয়েছেন মাহমুদুল হাসান। এ ছাড়া এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন তারিক আহমেদ। সুফিয়া কামাল হল: ভিপি পদে জান্নাতুন নাঈম সেরিন এবং জিএস হয়েছেন রুবিনা জাহান তিথি। রবীন্দ্রনাথ হল: ভিপি পদে অনিক কুমার বণিক ও জিএস মাহমুদুল হাসান ইমন পদে জয়লাভ করেছেন। খালেদা জিয়া হল: ভিপি পদে ফারহানা রহমান রিথি ও জিএস পদে জাতিমাতুজ জোহরা নির্বাচিত হয়েছেন। প্রীতিলতা হল: ভিপি পদে সুমাইয়া আক্তার ও জিএস পদে ইকফা রহমান নির্বাচিত হয়েছেন। ১৩ নং (ছাত্রী) হল: সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন নাহাদাতুন হাসানা। জিএস নির্বাচিত হয়েছেন মোহসিনা তুবা। এজিএস নির্বাচিত হয়েছেন সাদিয়া মেহজাবিন। নবাব ফয়জুন্নেসা হল: ভিপি পদে বুবলি আহমেদ (মার্কেটিং, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) ও জিএস সুমাইয়া খানম জয় পেয়েছেন।