চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে অস্ত্রধারী স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে। গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা প্রধান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। এতে ৯৫ জনকে নামীয় আসামি এবং আরও ৮০০ থেকে ১০০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। হাটহাজারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু কাওছার মোহাম্মদ হোসেন বলেন, এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। তবে এখনও কাউকেও আটক বা গ্রেফতারও করা হয়নি।

এদিকে নিরাপত্তা দপ্তর থেকে সংঘর্ষকালে লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্রের ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বছরের ৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে জব্দ হওয়া দেশীয় অস্ত্র নিরাপত্তা দপ্তরে সংরক্ষিত ছিল। গত ৩১ আগস্ট জোবরা গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় এসব অস্ত্র দপ্তর থেকে লুট হয়ে যায়।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, লুট হওয়া দেশীয় অস্ত্র যাদের কাছে আছে, তাদেরকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিরাপত্তা দপ্তরে জমা দিতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অস্ত্রধারী স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সোমবার রাতে উপাচার্যের দপ্তরে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তগুলো ঘোষণা করা হয়। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক কামাল উদ্দিন।

তিনি বলেন, “রোববার সংঘটিত সংঘর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক ঘটনা। এতে বহু শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

ঘোষিত সিদ্ধান্তগুলো হলো-১. আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে। ২. চিকিৎসা সেবা মনিটরিংয়ের জন্য ৫ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৩. শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় একটি মডেল থানা স্থাপনের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানানো হবে। ৪. রেলক্রসিং এলাকায় একটি পুলিশবক্স স্থাপন করা হবে। ৫. সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে (যা সোমবারই দায়ের করা হয়)। ৬. ঘটনার কারণ উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ৭. সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টায় জরুরি সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হবে। ৮. ২ নম্বর গেট সংলগ্ন জোবরা এলাকার বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। ৯. পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রত্যাহার না করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ১০. শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হটলাইন সার্ভিস চালু করা হবে।

এর আগে ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ছাত্র প্রতিনিধি ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত সম্প্রীতি কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয় বলে জানান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন। সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াহ্ইয়া আখতার, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক তৈয়ব চৌধুরীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে সংঘর্ষে গুরুতর আহত শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ টানা তিন দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। রোববার রাতে তাকে নগরের পাঁচলাইশ এলাকার পার্কভিউ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়।

হাসপাতালের আইসিইউতে দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসক গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জানান, ইমতিয়াজের কনশাস লেভেল এখনো ১৫-এর মধ্যে ৬/৭ রয়েছে। তার রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকলেও তিনি চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন।

একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও এক শিক্ষার্থী মামুন মিয়া, সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী। তারও মাথায় আঘাত লাগে। তাকে ইমতিয়াজের সঙ্গে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় সোমবার বিকেলে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো তাকে আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলাম গুরুতর আহত অবস্থায় রোববার ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি হন। অস্ত্রোপচারের পর রাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। তার সঙ্গে থাকা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ হাজারী জানান, নাইমুলের অস্ত্রোপচার সোমবার সম্পন্ন হয়েছে। তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন এবং খাওয়াদাওয়াও শুরু করেছেন। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করার ঘোষণা দিয়েছে। স্বজনদের প্রত্যাশা, এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবে।

এদিকে চবি সংলগ্ন জোবরা গ্রাম এখন আতঙ্কে নিস্তব্ধ। সংঘর্ষ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গ্রামের পুরুষরা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় গ্রামটি প্রায় ‘পুরুষশূন্য’ হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাটে দেখা মিলছে শুধু নারীদের। তবে তারাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। রাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে প্রতিরোধ করার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না— এই ভয়ে ভরসাহীন হয়ে পড়েছেন গ্রামবাসী। এ অবস্থায় পরিস্থিতি শান্ত করতে গতকাল মঙ্গলবার জোবরা এলাকা পরিদর্শন করেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন। ইউএনও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছিলেন। তবে সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে এলাকায় অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন ইতোমধ্যে উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, একাডেমিক ও সামাজিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা অপরিহার্য। গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীরা যেন পুনরায় মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারেন, সে লক্ষ্যে প্রশাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে সংঘর্ষ-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় মঙ্গলবারও বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা বহাল ছিল। ফলে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম।