২৫টির মধ্যে ২০ পদেই শিবির প্যানেলের জয়
ইবরাহীম খলিল/শহিদুল্লাহ মনসুর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাভার থেকে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ জাকসুর নির্বাচনেও শিবির সমর্থিত প্রার্থীদের জয়জয়কার। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করে। সাড়ে ৭২ ঘণ্টা পর এই ফল ঘোষিত হলো। এর মধ্যে অনেক অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের ঘটনা ঘটে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নামের একজন শিক্ষিকা মারা যান।
ঘোষিত ফলে সহসভাপতি (ভিপি) পদে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী মো. মাজহারুল ইসলাম। আর দুই এজিএস পদে যথাক্রমে ফেরদৌস আল হাসান (পুরুষ) এবং এজিএস (নারী) আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা জয় পেয়েছেন। চূড়ান্ত ফলে দেখা গেছে, জাকসুর মোট ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতেই ছাত্র শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করে জাকসু নির্বাচন কমিশন। এতে দেখা যায় ভিপি আব্দুর রশিদ জিতু (স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী প্যানেল) পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৩৪ ভোট। জিএস পদে ৩ হাজার ৯৩০ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন শিবির সমর্থিত প্রার্থী মো. মাজহারুল ইসলাম। জাকসুতে এজিএস পদ দুটি। দুটি পদেই শিবির সমর্থিত প্রার্থী জয় পেয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষ এজিএস পদে ফেরদৌস আল হাসান জয়ী হয়েছেন ২ হাজার ৩৫৮ ভোট পেয়ে। আর নারী এজিএস জয়ী হন ৩ হাজার ৪শ’২ ভোট পেয়ে।
জাকসু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়
ভিপি পদে জয় পেয়েছেন আব্দুর রশিদ জিতু ( স্বতন্ত্র প্যানেল ), সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন জিএস- মো: মাজহারুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), এজিএস (পুরুষ)- ফেরদৌস আল হাসান (শিবির প্যানেল), এজিএস (নারী)- আয়েশা সিদ্দীকা মেঘলা (শিবির প্যানেল)।
অন্যান্য সম্পাদকীয় পদগুলোতে জয় পেয়েছেন যথাক্রমেÑ শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক- আবু ওবায়দা ওসামা (শিবির প্যানেল), পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক- মো. শাফায়েত মীর (শিবির প্যানেল), সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক- মো. জাহিদুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), সাং¯ৃ‹তিক সম্পাদক- শেখ জিসান (স্বতন্ত্র), সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক- মো: রায়হান উদ্দীন (শিবির প্যানেল), নাট্য সম্পাদক- মো রুহুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), ক্রীড়া সম্পাদক-মাহমুদুল হাসান কিরন (স্বতন্ত্র), সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (নারী)- ফারহানা আক্তার লুবনা (শিবির প্যানেল), সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (পুরুষ)- মো. মাহাদী হাসান (শিবির প্যানেল), তথ্য প্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক- মো. রাশেদুল ইসলাম লিখন (শিবির প্যানেল), সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক- আহসাব লাবিব (বাগছাস), সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (নারী)- নিগার সুলতানা (শিবির প্যানেল), সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (পুরুষ)- মো. তৌহিদ হাসান (শিবির প্যানেল), স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পাদক- হুসনী মোবারক (শিবির প্যানেল), পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক- মো. তানভীর রহমান (শিবির প্যানেল)।
এদিকে কার্যকরী সদস্য পদে ১টি বাদে ৫টিতেই জয় পেয়েছে শিবির প্যানেল। এর মধ্যে কার্যকরী সদস্য হিসেবে জয় পান পুরুষ-১: মো. তরিকুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), পুরুষ-২: মো. আবু তালহা (শিবির প্যানেল), পুরুষ-৩: মোহাম্মদ আলী চিশতি (বাগছাস), নারী-১: নাবিলা বিনতে হারুণ (শিবির প্যানেল), নারী-২: ফাবলিহা জাহান (শিবির প্যানেল), নারী-৩: নুসরাত জাহান ইমা (শিবির প্যানেল)।
নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ
জাকসুর ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে ফল ঘোষণা পর্যন্ত নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। আর এই অব্যবস্থাপনার জেরে ভোট গণনা থেকে শুরু করে ফল ঘোষণায় দীর্ঘ প্রলম্বিত হয়। আগের দিন নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. অধ্যাপক সুলতানা আক্তার অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনার জন্যই ফলাফল প্রকাশে দেরি হয়েছে। সেইসাথে অতিরিক্ত কাজের চাপে শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে জাকসু নির্বাচনের ফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় ছাত্রসংগঠনের নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা। সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন শিক্ষক হার্ট অ্যাটাক করে ইন্তিকাল করেছেন। এটা নিয়েও তারা রাজনীতি করতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি লন্ডন থেকে একটি প্রেসক্রিপশন এসেছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন বানচাল করতে চাচ্ছেন কিছু লোকজন। ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। রাতে তারা দেশে বসে লন্ডনে জুম মিটিং করেছে। লন্ডনের এজেন্ডা জাহাঙ্গীরনগরে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন। আমরা বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের রায় মেনে নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে মেনে নিতে হবে। জয় হলেও মেনে নিতে হবে। পরাজয় হলেও মেনে নিতে হবে।
শুক্রবার দুপুরের পর দীর্ঘক্ষণ বিরতির পর আবার ভোট গণনা শুরু হয় সন্ধ্যার দিকে। এবারও ম্যানুয়ালি বা হাতেই গণনা শুরু হয়। তিনদিনের মাথায় গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর আরও দুইদিনেও ফল না পেয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও টানা দায়িত্বপালন করে বিরক্তি প্রকাশ করেন। সংবাদকর্মীরাও জাবির সিনেট অফিস প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাননি।
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতানা আক্তার বলেন, ম্যানুয়ালি গণনার সিদ্ধান্তের কারণে জান্নাতুল ফেরদৌসের মৃত্যু হয়েছে। কারণ তাকে বৃহস্পতিবার সারাদিন অমানসিক পরিশ্রমের পরও পরদিন শুক্রবার চাপ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
যে কারণে ফল দেরি
১১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকালে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল সমর্থিত প্যানেল। তাদের অভিযোগ ছিল জামায়াত নেতার কোম্পানী থেকে ও এম আর মেশিন কেনা হয়েছে। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর আরও কিছু ঘটনা ঘটে। ভোট গণনার সময় জান্নাতুল ফেরদৌস নামের চারুকলার একজন শিক্ষিকার মৃত্যু হয়। শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন জাকসু নিবার্চন কমিশনের সদস্য মাফরুহী সাত্তার। মাফরুহী সাত্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি।
এসব ঘটনায় প্রার্থী এবং শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব করা হয়েছে। নির্বাচন বানচালের জন্য নাটক করা হয়েছে। সব শেষ শুক্রবার রাতে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন যে ফল ছাড়া তারা সিনেটভবন ছাড়বেন না। এই প্রেক্ষিতে শুক্রবার রাতে গণনার জন্য কয়েকটি টেবিল বসানো হয়। তখন বলা হয় যে কোন উপায়ে রাতেই ফল ঘোষণা করা হবে। এরপরও হাতে ভোট গণনার কারণে দীর্ঘ তিনদিন লেগে যায় ফল ঘোষণা করতে। গতকাল দুপুর ২টার পর ভোট গণনা শেষ হয়। আর ফল ঘোষণা করা হয় সাড়ে ৫টায়।
শেষঅবধি ফল ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ এমন মন্তব্য করেন যে, অপেক্ষার ফল সুমিষ্টই হয়। তেত্রিশ বছর পর নতুন ইতিহাস গড়লো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দম্পতির জয়
ডাকসুর মতো জাকসুতেও এক দম্পতি জয় পেয়েছেন। স্বামী তরিকুল ইসলাম জয় পেয়েছেন সদস্য পদে। আর স্ত্রী নিগার সুলতানা জয় পেয়েছেন সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক পদে। তারা দুজনই শিবির প্যানেলের। তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন লোকজন।
ছাত্রদল পায়নি একটিও
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচন জাকসুতেও কোন পদ পায়নি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। জাকসুর ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা। বাকী ৫টি পেয়েছেন স্বতন্ত্র এবং বাগছাস সমর্থকরা। ভোটের দিন বিকালে নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করে ছাত্রলদের প্রার্থীরা।