সাকীফ বিন আলম, ইবি: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এটি। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরে পদার্পণ করেছে ১৭৫ একরের এই বিদ্যাপীঠ। আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) পালিত হবে ৪৭তম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উচ্চশিক্ষার প্রসার, জ্ঞানচর্চা ও নতুন জ্ঞান উদ্ভাবনে সক্ষম মানবসম্পদ তৈরি করা। তবে সময়ের বিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। যুগে যুগে ইসলামী শিক্ষার পরিসর সংকুচিত করা হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠার আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

৭৬ বছরের আন্দোলনের ফসল

ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বাংলার মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম দাবি ওঠে ১৯০৩ সালে। ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় ক্রমান্বয়ে হিন্দু-প্রবাহিত হয়ে পড়লে একে হিন্দু বিশ^বিদ্যালয় আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক একটি বিশ^বিদ্যালয়ের দাবি তোলেন ‘নবনূর’ পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ এমদাদ আলী, সৈয়দ আমীর আলী, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ। ১৯২১ সালে সে দাবির প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের সংযুক্তির কথা থাকলেও তা বিভাগেই সীমাবদ্ধ থাকে। সরকার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গেলে দাবির বাস্তবায়নে আবারও সোচ্চার হন দেশের খ্যাতনামা আলেমগণ। মওলানা আকরম খাঁ ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে দাবি আদায়ে কাজ করতে থাকে ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা’। ১৯২০ সালে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ব্যক্তিগত উদ্যোগে চট্টগ্রামে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ফান্ডও গঠন করেন। যার সাথে একাত্মতা জানিয়েছিলেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, আব্দুল হামীদ খান ভাসানীসহ প্রথম সারির আলেমসমাজ। ১৯২৯ এ ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন কলকাতা আলিয়ার ছাত্রসংগঠন ‘জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া’। পরে ১৯৩৯ এ শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের গড়া ‘মাদরাসা শিক্ষা কমিটি’ ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৪১ সালে মাওলা বক্স কমিটি, ১৯৪৬-৪৭ সালে সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দীন হোসেন কমিটি, ১৯৪৯ সালে মওলানা আকরম খাঁ কমিটি, ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খান কমিশন, ১৯৫৮ সালের এস.এম শরীফ শিক্ষা কমিশন ও ১৯৬৩ সালের ড. এস.এম হোসাইন কমিশন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। স্বাধীনতার পর ড. কুদরত-ই-ে খোদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষা সমন্বয়ের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৭৪ সালে মওলানা ভাসানী সন্তোষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারিভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর সরকারিভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে শন্তিডাঙ্গা-দুলালপুর নামক স্থানে ১৭৫ একর জমিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় লক্ষ্যচ্যুত

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিলো আধুনিক ও ধর্মীয় দুই ধারার শিক্ষার্থীদের একত্র করে সমন্বিত শিক্ষা তৈরি করা, যাতে মাদরাসা এবং সাধারণ শিক্ষার ছাত্ররা একই পরিবেশে পড়াশোনা, বসবাস ও জ্ঞানবিনিময়ের সুযোগ পায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রাপ্তির ঝুলি শূন্যপ্রায়। শুরুতে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ছিল। জেনারেল ডিপার্টমেন্টগুলোতে ইসলামিক স্টাডিজ পড়ানো হতো। এতে শিক্ষার্থীরা দুই ধারার জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক পরিবর্তন ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে এই ব্যবস্থা ভেঙে যায়। বিভাগগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে যেতে যেতে এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে হিন্দু শিক্ষক দিয়ে ইসলামিক স্টাডিজ পড়ানোর নজির আছে। এদিকে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে খোলা হয়েছে ৩০টির বেশি জেনারেল ডিপার্টমেন্ট অন্যদিকে ইসলাম বিষয়ক রয়েছে মাত্র ৩ টি, যা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া গত চারযুগ ধরে নতুন ইসলামিক বিভাগ খোলায় বাধা, শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘ স্থবিরতা এবং নীতিগত সমস্যার কারণে ইসলামিক জ্ঞান নিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। মসজিদকে কেন্দ্র করে একাডেমিক ভবনের সংযুক্তি বা ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তোলার মতো প্রাথমিক পরিকল্পনাগুলিও বাস্তবে সফল হয়নি। বাস্তবায়িত হয়নি পূর্ণাঙ্গ আবাসিকিকরণের পরিকল্পনাও। জেনারেল বিভাগগুলোতে ১০% মাদরাসা ছাত্র ভর্তি করার নিয়ম বিলোপ, প্রতিষ্ঠাকালীন ‘কানুন ও শরীয়াহ অনুষদ’-এর স্বকীয়তা নষ্ট করতে নাম পরিবর্তন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যর সাথে সাংঘর্ষিক বিভাগ চালু, একমাত্র ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ৪ দশক পরেও গবেষণা শূন্য থাকাÑ সবই লক্ষ্যচ্যুত যাত্রার বাস্তব উদাহরণ। থিওলজি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. আ.ন.ম এরশাদ উল্লাহ বলেন, “ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মূলত ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। শুরুতে দুই ধরনের শিক্ষার্থীর মিলন ও পারস্পরিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু পরে এটি থেমে যায়। অনেক ডিপার্টমেন্ট ও প্রশাসনিক কারণে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। ক্যাম্পাসে মসজিদের সংযুক্তি এবং শিক্ষার সমন্বয়ও কার্যকর হয়নি। বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তবে সামগ্রিকভাবে মূল লক্ষ্য পূরণ এখনও অসম্পূর্ণ।

ওআইসির অধীনে না থাকার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

১৯৭৭ সালের এপ্রিলে মক্কা শরীফে ওআইসি-এর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুসলমান রাষ্ট্রের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যোগদান করেন। সেখানে ওআইসি এবং বিভিন্ন মুসলমান রাষ্ট্রের অর্থানুকূল্যে এশিয়ার তিনটি মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যে সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হওয়ার কথা ছিলো। মালয়েশিয়া এবং পাকিস্তানে বাস্তবায়ন হলেও তৎকালীন সরকারের অসহযোগিতায় সে পথ রুদ্ধ হয়। ফলে দেশে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও হয়নি আন্তর্জাতিক মানের। যেখানে অন্য বিশ^বিদ্যালয়গুলো র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ^সেরার তালিকায় থাকে, সেখানে সেই তালিকাতেই তলানিতে থাকে ইবি। এর কারণ দর্শাতে গিয়ে থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সেকান্দার আলী বলেন, “আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মান বা গতিবিধি, শিক্ষক এবং ছাত্র সেটা এখানে অনুপস্থিত। ওই দুটি বিশ্¦বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও আরবি ভাষায় লেখাপড়া হয়। অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডিতে মার্কস ডিস্ট্রিবিউশনও প্রায় অর্ধেক অর্ধেক। এর সাথে বিভিন্ন দেশের শিক্ষক এবং ছাত্র থাকে। তাদের একটা পার্সেন্টেজ ঠিক করা আছে যে এত পার্সেন্ট ছাত্র পাকিস্তান, এত মালয়েশিয়া থেকে ভর্তি হবে। বাংলাদেশেও ঠিক তাই হতো। নির্ধারিত থাকতো ছাত্র এবং শিক্ষক এত পার্সেন্ট থাকবে। কিন্তু এই বিষয়টা এখানে অনুপস্থিত। এখানে আমরাই হানড্রেড পার্সেন্ট। আর ঠিক এখানেই আমরা অনেকগুণ পিছিয়ে।”

ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের স্বরূপ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক শিক্ষাক্রম, যেখানে জ্ঞানার্জনের পুরো কাঠামো ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু ধর্মীয় বিষয়াদি নয়, বরং বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, কলা, আইনসহ সব ক্ষেত্রেই ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমানভাবে প্রতিফলিত হয়। যেখানে জ্ঞানের দুটি বৃহৎ ধারার সমন্বয় থাকে, ইসলামি জ্ঞান ( কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আকিদা, ইসলাহী চিন্তা) এবং আধুনিক জ্ঞান (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, আইন, ভাষা, ইত্যাদি)। এই দুই ধারাকে আলাদা না করে এর সমন্বয়সাধন ই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরূপ। আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক অধ্যাপক ড. আ.ব.ম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, “যতই ইসলামিক বিভাগই খোলা হোক না কেন দাওয়াহ, কুরআন, হাদিস বা আল-ফিকহের মত একশ বিভাগ খোলা হলেও তা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় না। এর প্রকৃত স্বরূপ হলো সাধারণ জ্ঞান ও ঐশী জ্ঞানের সমন্বয়। এখানে সেই সমন্বয় অনুপস্থিত, কারণ সাধারণ বিভাগের ছাত্ররা কুরআন পড়তে জানে না, বেসিক ইসলামি জ্ঞানও পায় না, আর পাঠ্যক্রমে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করার কাজ হয়নি। অন্য আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিটি বিষয়ে চারটি করে ইসলামিক কোর্স থাকা উচিত, যাতে ইকোনমিক্স, ল, ম্যানেজমেন্টসহ সব জেনারেল সাবজেক্টই ইসলামাইজ হয়।”

একাডেমিক সিলেবাস প্রণয়নে সমন্বয়হীনতা

আধুনিক জ্ঞানের সাথে ইসলামী জ্ঞানের সমন্বয়ের লক্ষ্য-উদ্দ্যেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক সিলেবাস লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যথেষ্ট অসম্পূর্ণ। জেনারেল বিভাগগুলোর সিলেবাসে ইসলামী বিষয়সমূহের সংযোজন নামমাত্র। প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে দাওয়াহ, কুরআন, হাদিস ও ফিকহসহ বেশ কিছু ইসলামিক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলেও জেনারেল সব বিভাগের জন্য মাত্র ১০০ নম্বরের ইসলামিক স্টাডিজ বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে, যা প্রকৃত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদ-ের সাথে যায় না। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এখানে প্রতিটি বিষয়ে দ্বৈত সিলেবাস অর্থাৎ ইসলামিক জ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানের সমন্বয় করা হয়নি। পাকিস্তান বা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থনীতি পড়লে ছাত্ররা ইসলামী অর্থনীতি এবং সাধারণ অর্থনীতি দুটোই সমান গুরুত্বে পড়ে, আইন বিভাগে ইসলামী আইন ও সাধারণ আইন সমানভাবে পড়ানো হয়। সেখানে পুরো কাঠামোটাই প্রায় ৫০:৫০ অনুপাতে সাজানো থাকে। কিন্তু ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে এই একাডেমিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত।

ইসলামবিদ্বেষী প্রশাসনের ছোবল

ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধনের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও কাল পরিক্রমায় ইসলাম বিদ্বেষকেই বানানো হয়েছিলো তথাকথিত উন্নয়নের হাতিয়ার। যেখানে ক্রিড়ানক হিসেকে কাজ করেছে বিভিন্ন সময়ের ফ্যাসিবাদি প্রশাসন। একদিকে তাদের যেমন ছিলো বিশ^বিদ্যালয়কে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করার অব্যহত প্রচেষ্টা অন্যদিকে নিগৃহিত ইসলামপন্থিদের উপর চালিয়েছে জুলুম-নির্যাতনের স্টিমরোলার। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করতে টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখা আওয়ামী লীগ বিরামহীনভাবে কাজ করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধাঁচে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে একচেটিয়া দলীয় লোক নিয়োগ করা হয়। আওয়ামী প্রশাসন নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, সংঘাত, সংঘর্ষ, বন্দুকযুদ্ধ, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, অশ্লীলতা, শ্লীলতাহানি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশি রাজত্ব, চুরি ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলো এই ইবি ক্যাম্পাস। এরই সাথে স্বর্বস্তরে থিওলজি অনুষদের নিগ্রহ ও অনুষদভুক্ত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ট্যাগিং থেকে শুরু করে ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মুহাম্মাদ ওয়ালিউল্লাহ এবং আল ফিকহ এন্ড ল বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আল-মুকাদ্দাসকে ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে ফিরার পথে তৎকালীন প্রশাসনের মদদে র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ, ২০১৭ সালে জঙ্গী তৈরীর কারখানা আখ্যা দিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় মসজিদে পরিচালিত নূরানী মক্তব বন্ধ, নারী শিক্ষার্থীদের নিকাব-পর্দা করার কারণে জঙ্গি সাজিয়ে হয়রানি, নিরাপরাধ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার হল থেকে ধরে নিয়ে জঙ্গি বানিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া, ইসলামী শিক্ষাকে ধ্বংস করবার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন, শুধু ‘অপরাধ ছাত্রশিবির করেছে’ মর্মে সাক্ষী নেয়ার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে দেয়ার জন্য চোখে কালো কাপড় বেঁধে তিন দিন পর্যন্ত আটকে রাখা, প্রক্টর বাদী হয়ে ৭০ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে হয়রানি মামলা, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সেই আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্য ছাত্রদেরকে পূর্ববর্তী গুমের উদাহরণ টেনে গুম করার হুমকি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশ^বিদ্যালয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যর সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বিভাগ চালুসহ নানান ইসলামবিদ্বেষী কর্মকা-ে বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইসলামকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করে গেছে আওয়ামী প্রশাসন।

গণঅভ্যুত্থানের পরে লক্ষ্যে ফিরার আশ^াস বাস্তবায়ন কতদূর?

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্দশ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। নিয়োগ পরবর্তী সময়ে তিনি বিশ^বিদ্যালয়কে লক্ষ্যপানে ফিরিয়ে নেবার আশ^াস দিয়ে বলেছিলেন, “শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার সংমিশ্রণ ঘটানোর লক্ষ্যেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন। আমরা সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করব। আধুনিক শিক্ষাকে বাদ দিয়ে যেমন জাগতিক জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে না, তদ্রুপ ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন না ঘটালে সুন্দর সমাজ গঠনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হবে না। এজন্য আমার মূল কাজ হবে শিক্ষার সংস্কার।” উপাচার্যের এই আশ^াসের বছর পেরিয়েছে। বাস্তবায়নে শতভাগ সফল না হলেও তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই অর্গানোগ্রামে থাকা ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’ নামের অনুষদ বাস্তবায়ন ও তার অধীনে ৩টি নতুন বিভাগ চালুর ঘোষণা, থিওলজি অনুষদে ‘কম্পারেটিভ তাফসির’ ও ‘আস-সিরাহ আস-নববিয়্যাহ’ নামের দুটি নতুন বিভাগ সংযুক্ত, ‘অনুষদ ভবন’ এর প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ‘থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদ ভবন’-এ ফিরিয়ে দেয়া, ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তার স্বরূপে ফেরানোর উদ্যোগ লক্ষ্যে বাস্তবায়নের অংশ। তবে জেনারেল বিভাগসমুহের সিলেবাসে ইসলামী জ্ঞানের যথাযথ সমন্বয়, পূর্ণ আবাসিকতা নিশ্চিত, সেশন জট নিরসন, ডিজিটালাইজেশন ও আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বিচার নিশ্চিতকরণে এখনো পুরোপুরি সফল হতে পারেনি প্রশাসন। শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, “ফ্যাসিবাদীদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে বিভিন্ন সময় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় তার লক্ষ্যপথে খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা যত দ্রুত গবেষণায় অগ্রসর হওয়ার প্রত্যাশা রেখেছিলাম, ততটুকু হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের যে মূল স্পিরিট ছিল, ৫ই আগস্টের পরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার নিজস্ব স্বকীয়তায় ফিরিয়ে আনতে, নিজস্ব লক্ষ্যের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যে যে পদক্ষেপ প্রয়োজন তা অতি দ্রুত নেয়া দরকার।” উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, “ইসলামিক অ্যান্ড কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’ চালু করে এর অধীনে তিনটি নতুন বিভাগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যেগুলোসহ মোট আটটি বিভাগ চালু করা হবে। তাহলে অন্ততপক্ষে একটি সমন্বয় সাধিত হবে। যাতে ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় একটি শক্তিশালী শিক্ষার্থী ও রিসার্চ গ্রুপ তৈরি হবে।”

থিওলজি অনুষদ দীর্ঘমেয়াদি অবহেলার শিকার : ডিন ড. সেকান্দার আলী

থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সেকান্দার আলী বলেন, “ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রার শুরু থেকেই লক্ষ্যচ্যুত ছিল। এটিকে ওআইসি অনুমোদিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তৎকালীন প্রশাসন গ্রহণ করেনি; তারা আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের বদলে নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চেয়েছিল। যার ফলে যেখানে একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরবি-ইংরেজিতে দ্বৈত সিলেবাস, বিদেশি শিক্ষক-ছাত্র, আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ এবং ৫০:৫০ অনুপাতে ইসলামিক ও জেনারেল নলেজের সমন্বিত পাঠ্যক্রমে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষস্থান দখল করলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এখনো কোনো আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা-কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। এখানে জেনারেল বিভাগগুলোতে মাত্র ১০০ নম্বরের ইসলামিক স্টাডিজ ছাড়া কোনো ইসলামাইজড কারিকুলাম নেই, সিলেবাসগুলো ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তুত নয়, আছে আরবি ও ইংরেজির ভাষাগত দক্ষতার ঘাটতি এবং শিক্ষক-ছাত্র সব স্থানীয় হওয়ায় আন্তর্জাতিক পরিবেশ গড়ে উঠেনি। অতীতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে থিওলজি অনুষদ উপেক্ষিত হয়েছে, প্রায় ১৫-১৬ বছর শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ছিল, এমফিল-পিএইচডির নীতিমালা কঠোর করে তাদের অগ্রগতি থামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, যদিও থিওলজি বিভাগের ছাত্ররা আরবি-ইংরেজি দক্ষতার কারণে পরীক্ষায় এগিয়ে থেকেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে গেলেও, প্রকৃত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পেতে হলে আন্তর্জাতিক সিলেবাস, দ্বিভাষিক শিক্ষা, ইসলামিক ও জেনারেল নলেজে সমান পারদর্শী ‘টু-ইন-ওয়ান’ যোগ্যতা সম্পন্ন দক্ষ শিক্ষক এবং ইসলামাইজড জেনারেল কারিকুলামের সমন্বয় জরুরি।”

থিওলজি বিভাগ ৩ থেকে ৮ হলে সমন্বয় সাধিত হবে: ভিসি ড. নসরুল্লাহ

ভিসি অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামিক ও আধুনিক জ্ঞানকে একত্রে বিকাশ করা, কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালীন থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ ফ্যাকাল্টি মাত্র তিনটি বিভাগ নিয়ে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় আছে। তাই স্ট্যাটিউট অনুযায়ী পূর্বে অনুমোদিত দুটি বিভাগ পুনরায় একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালুর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং শিগগিরই তাদের চেয়ারম্যান ও সিলেবাস প্রণয়নের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হবে। পাশাপাশি নতুন স্ট্যাটিউটভুক্ত ফ্যাকাল্টি ‘ইসলামিক অ্যান্ড কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’ চালু করে এর অধীনে তিনটি নতুন বিভাগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যেগুলোসহ মোট আটটি বিভাগ চালু করা হবে। তাহলে অন্ততপক্ষে একটি সমন্বয় সাধিত হবে। যাতে ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় একটি শক্তিশালী শিক্ষার্থী ও রিসার্চ গ্রুপ তৈরি হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এতদিন শুধু পাঠদানে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই গবেষণা-ভিত্তিক পরিবেশ গড়ে তুলতে থিওলজির তিনটি বিভাগে তিনটি রিসার্চ সেন্টার, ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচারে একটি, এবং পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ‘সেন্টার ফর গভর্নেন্স’সহ মোট পাঁচটি রিসার্চ সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার কার্যক্রম শীঘ্রই শুরু হবে।”