বহু বছর ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি ছিল মূলত জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে আবদ্ধ—যেখানে জাকসু নির্বাচন এক পরিত্যক্ত স্বপ্ন হয়ে পড়েছিল। ছাত্র সংগঠনগুলো কেবল কেন্দ্রীয় দলের ছায়া হয়ে চলেছে, নিজেদের স্বর, দাবি ও সংগ্রাম হারিয়ে ফেলেছিল ক্ষমতার ছায়াযুদ্ধে। কিন্তু জাকসু নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল সেই গ্লানিকর বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসার এক ঐতিহাসিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।

নতুন ঘোষিত তফসিলকে কেন্দ্র করে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে যেমন একদিকে জন্ম নিয়েছে আশাবাদ, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন ও উদ্বেগ। অনেকেই এই নির্বাচনকে দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে একটি গণতান্ত্রিক চর্চার নবসূচনা হিসেবে দেখলেও, কেউ কেউ প্রশাসনের সদিচ্ছা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দিহান।

গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে সিনেটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি ছিলো না। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো অনেকাংশে উপেক্ষিত হতো। আমরা আশাকরি এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা ফিরে পাব সাংবিধানিক অধিকার, প্রতিনিধিত্ব এবং জবাবদিহিতামূলক নেতৃত্ব। নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশে 'জাকসু' নির্বাচন গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্র চর্চার রোল মডেল হবে৷

শাখা শিবিরের দপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ছাত্রদের প্রাপ্য সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ছাত্রসমাজের প্রত্যাশার প্রতিফলন।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি—এই নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরাপদ হয়, সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতা বজায় রাখা জরুরি। বিশেষ করে, জুলাইয়ে সংঘটিত হামলার যথাযথ বিচার ও সকল পক্ষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করেই নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। তাহলেই জাকসু নির্বাচন দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।”

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মী হামিদুল্লাহ সালমান বলেন, “দীর্ঘ অচলায়তনের আজকের ঘোষিত তফসিলের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একটি নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। কারণ, জাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদল শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল, এখনো আছে এবং আগামীতেও থাকবে।”

তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে যে সংগঠন, তার নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। আমি বিশ্বাস করি, ৩১ জুলাইয়ের নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সূচনা করবে এবং ছাত্রদল এই নির্বাচনে বিজয়ের ধারা বজায় রাখবে।”

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সংগঠক সজীব আহমেদ জেনিচ বলেন, “নির্বাচনে এত দীর্ঘ সময় নেওয়া জাকসু নিয়ে প্রশাসনের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাছাড়া ভোটকেন্দ্র হবে আবাসিক হলগুলোতে হলে প্রার্থীদের আধিপত্য, লবিং ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেদিক বিবেচনায় আমরা ভোটকেন্দ্র হিসেবে একাডেমিক ভবনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রশাসন তা কর্ণপাত করেনি। নির্বাচনী কর্মকর্তা, এজেন্ট নির্ধারণেও রয়েছে অস্পষ্টতা।

তিনি আরও বলেন, “গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পদাধিকার বলে উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ যথাক্রমে জাকসুর সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ থাকবেন, যেটি জাকসুতে প্রশাসনের আধিপত্য জিইয়ে রাখবে। সব মিলিয়ে আমরা এখনো সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। তবে আমরা আশাবাদী—জাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে জাহাঙ্গীরনগর একটি নতুন গণতান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করবে।”

ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য বলেন, জাকসুর তফসিল ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা চাই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু প্রশাসনে পতিত স্বৈরাচারের দালালদের রেখে দিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না, তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন আয়ান বলেন, “বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, ডাকসু কার্যকরের মধ্য দিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোর কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হতো। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে সারাদেশে নজির স্থাপন হয়েছে। আমরা মনে করি, আগামী ৩১ জুলাই অবাধ ও সুষ্ঠু জাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের অন্যান্য ছাত্র সংসদগুলো কার্যকরের জন্য দিশারী হয়ে উঠবে।”