আগামীকাল রাত পোহালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। এজন্য গতকাল রোববার প্রচারণার শেষ দিন ছিল। তাই নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে শেষ সময়ে ব্যস্ত ছিলেন প্রার্থী ও সমর্থকরা। শিক্ষার্থীরাও দিয়েছেন আশার বাণি। গণসংযোগ, মিছিল ও শপথ অনুষ্ঠানসহ সব জায়গাতেই নিজেদের প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন প্রার্থীরা।
গতকাল রোববার ঢাবি ক্যাম্পাসের টিএসসি চত্বর, মধুর ক্যান্টিন, আর্টস ফ্যাকাল্টি, মল চত্বর, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ও গণগ্রন্থাগারসহ সব জায়গায় ছিল শিক্ষার্থীদের জটলা। সেখানে তাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করেছেন বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থী ও সমর্থকরা। আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের আড্ডায় আলোচনার প্রধান উপজীব্য ছিল ডাকসু নির্বাচন। কে হচ্ছেন ডাকসুর আগামী দিনের ভিপি, তা নিয়ে কষছেন নানা হিসাব-নিকাশ।
এদিকে কোনো ধরনের গুজবে কান না দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এই নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। গতকাল রোববার বিকেলে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের সামনে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন এ আহ্বান জানান। ব্রিফিংয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, কাজী মারুফুল ইসলাম, এস এম শামীম রেজা, সহযোগী অধ্যাপক শারমীন কবীরও কথা বলেন।
প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন বলেন, ‘গুজব একটি সামাজিক ব্যাধি। কোনো ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু চারদিকে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের গুজব হতে পারেÑঅমুক প্রার্থী চলে গেছে, অমুক প্রার্থী আরেকজনকে সমর্থন করছে। তাই ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচনকে ঘিরে কোনো ধরনের গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে কোনো গুজব ছড়ালে সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের যোগাযোগ করার অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইটে খোঁজ রাখবেন। সঠিক তথ্য জানতে চাইলে আমাদের কাছে আসবেন। কোনো গুজবে কান দেবেন না।
নকল পরিচয়পত্র বানানো হচ্ছে জানিয়ে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে আমাদের কাছে সংবাদ আসছে। তাদেরকে প্রতিহত করতে পরিচয় নিশ্চিত করে ভোটকেন্দ্রে ঢোকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি কেউ ধরা পড়ে, তাকে সরাসরি পুলিশে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবে বৈধ ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের ভোট দিতে পারবেন। ভোটকেন্দ্রে বুথ সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, বুথ সংখ্যা নিয়ে নির্বাচনের বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে শঙ্কা ছিল। আগে ৮ কেন্দ্রে ৭১০ বুথ ছিল। পরে সেটি বাড়িয়ে ৮১০ করা হয়েছে, যাতে আবাসিক-অনাবাসিক ভোটারদের কোনোভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হতে না হয়।
রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে ভোট চাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের কোনো তথ্য কাউকে সরবরাহ করিনি। আমরা এমন অভিযোগ আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দপ্তরে খোঁজ নিয়েছি। ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাভিত্তিক গ্রুপ, বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত থাকে। সেখান থেকে ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়ে থাকতে পারে। এর সঙ্গে কমিশনের কোনো সম্পর্ক নেই।
ব্রেইল পদ্ধতিতে ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা সহযোগী অধ্যাপক শারমীন কবীর বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থীর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং যাঁরা ব্রেইল পড়তে পারেন, তাঁদের জন্য প্রথমবারের মতো আমরা ব্রেইল পদ্ধতিতে ব্যালট পেপার ছাপিয়েছি।
আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘প্রচার শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যতগুলো আচরণবিধি–সংক্রান্ত অভিযোগ পেয়েছি, সব কটির বিষয়েই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এর মধ্যে কোনোটিতে মৌখিক, কোনোটিতে মুঠোফোনে সতর্ক করেছি। আবার কোনোটি লিখিত আকারে সতর্ক করেছি। পাশাপাশি দুটি ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
গতকাল জোহরের নামাজের পর সমাজবিজ্ঞান ভবনের সামনে প্রচারণা চালান ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের দোয়া চান। বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লব হবে। তিনিও বৈষম্যহীন নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানান।
দুপুরে আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলের সদস্যরা। এতে উপস্থিত ছিলেন ওই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান, জিএস শেখ তানভীর বারী হামীম ও এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ। তারা শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন।
বিকাল ৩টায় গণগ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গণসংযোগ করেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত প্যানেল বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী আবদুল কাদের। একই সময় আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে প্রচারণা চালান ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত ডাকসু ফর চেঞ্জ প্যানেলের বিন ইয়ামীন মোল্লা। দুপুর আড়াইটায় মধুর ক্যান্টিনের সামনে থেকে মিছিলে নেতৃত্ব দেন ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী নাইম হাসান হৃদয়। তারা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষদ প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা।
অপরদিকে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের উমামা ফাতেমা এবং বাম জোটের প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদের শেখ তাসনিম আফরোজ ইমিও বিভিন্ন আবাসিক হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে ভোট চান। শুধু ভিপি প্রার্থীরাই নন, জিএস ও এজিএসসহ সব পদের প্রার্থীরাই শেষ মুহূর্তে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালান। তারাও নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা নিয়ে আজ রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তিনি এ নির্দেশ দেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘ডাকসু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। পতিত ও পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি যখন দেখছে দেশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং জুলাইয়ের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের বিচার যত দ্রুততর হচ্ছে, তারা তত বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এটি কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু। তারা দেশের সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করার জন্য সকল শক্তি নিয়ে মাঠে নামছে।
শফিকুল আলম জানান, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, দেশের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কাউকে ন্যূনতম ছাড় দেওয়া হবে না। সরকার মনে করে দেশের স্বার্থে জনগণের সঙ্গে সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকা অপরিহার্য।