নূর আলম নেহাল, রাবি থেকে : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনেও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয় হয়েছে। রাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে সভাপতি ও এজিএসসহ মোট ২৩টি পদের মধ্যে ২০টিতে তারা বিজয় অর্জন করে। এছাড়া ১৭টি হল সংসদের সবগুলোতে শিবির সমর্থিত সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট ও ইসলামী ছাত্রীসংস্থার প্যানেল জয়ী হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ভোটগ্রহণ শেষে কবি কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে গণনা চলে রাতভর। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এসময় প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় সংসদে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছেন শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে বিজয়ী হয়েছেন সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার। এছাড়া সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে জয়ী হয়েছেন এস এম সালমান সাব্বির। মোস্তাকুর ও সাব্বির দুজনই ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী ছিলেন।
ভিপি পদে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট পেয়েছেন মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের শেখ নূর উদ্দীন আবীর ভোট পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৯৭। ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের তাসিন খান ভোট পেয়েছেন ১ হাজার ৬২১ ভোট। এ পদে ১৫ জন প্রার্থী ভোট পান ৬শ’র নিচে। জিএস পদে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫৪৬ ভোট পেয়েছেন সাবেক সমন্বয়ক ও ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ জোটের সালাহউদ্দিন আম্মার। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের’ ফাহিম রেজা পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৯ ভোট। ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্মের’ প্যানেলের নাফিউল ইসলাম জীবন ভোট পেয়েছেন ১ হাজার ৩২৮ ভোট। এ পদে বাকি ১০জন প্রার্থী ৩ শ’র নিচে ভোট পেয়েছেন। ৬ হাজার ৯৭৮ ভোট পেয়ে এজিএস হয়েছেন ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের’ এস এম সালমান সাব্বির। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্মের’ জাহিন বিশ্বাস এষা ভোট পেয়েছেন ৫ হাজার ৯৪১ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সজিবুর রহমান ২ হাজার ৯০৭ ভোট পেয়েছেন।
শিবিরের প্যানেল থেকে নির্বাচিত : শিবির সমর্থিত সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট প্যানেল থেকে সহকারী ক্রীড়া ও খেলাধুলা সম্পাদক আবু সাঈদ মুহাম্মাদ নুন (সামি), সংস্কৃতি সম্পাদক পদে জায়িদ হাসান জোহা, সহকারী সংস্কৃতি সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম, মহিলা সম্পাদক সাইয়িদা হাফছা, সহকারী মহিলা সম্পাদক পদে সামিয়া জাহান, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বি এম নাজমুছ সাকিব, সহকারী তথ্য ও গবেষণা সিফাত আবু সালেহ, মিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে মো. মুজাহিদুল ইসলাম, সহকারী মিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক আসাদুল্লাহ গালিব, সহকারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে মুজাহিদুল ইসলাম সাঈম, বিতর্ক ও সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক ইমরান লস্কর এবং সহকারী বিতর্ক ও সাহিত্য সম্পাদক মো. নয়ন হোসেন, পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ মাসুমা ইসরাত। এ ছাড়া নির্বাহী সদস্যপদের চারটিতেই শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। তারা হলেন মো. দীপ মাহবুব, সুজন চন্দ্র, মো. ইমজিয়াউল হক কামালি ও এ বি এম খালেদ। রাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে কার্যনির্বাহী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন সনাতন ধর্মালম্বী শিক্ষার্থী সুজন চন্দ্র। সুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাসা দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায়। এছাড়াও রাকসু নির্বাচনে কার্যনির্বাহী সদস্য পদে ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল থেকে বিজয়ী হয়েছেন জুলাই আন্দোলনে চোখ হারানো আইবিএ’র শিক্ষার্থী দ্বীপ মাহবুব।
শিবির প্যানেলের বাইরে থেকে জয় : শিবির প্যানেলের বাইরে শীর্ষ তিন পদের জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী ও সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার। তিনি মোট ভোট পেয়েছেন ১১ হাজার ৫৩৭টি। তার নিকটতম শিবিরের প্যানেলের জিএস প্রার্থী ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৯ ভোট। এছাড়াও ক্রীড়া ও খেলাধুলা বিষয়ক সম্পাদক পদে জয় পান ছাত্রদল প্যানেলের নার্গিস খাতুন। তার প্রাপ্ত ভোট ৭৭৮৫। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের একজন খেলোয়াড়। এছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একমাত্র জয় পেয়েছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী তোফায়েল আহমেদ তোফা।
নবনির্বাচিত রাকসু ভিপির বক্তব্য : নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রাকসু ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ‘শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট’ অনুযায়ী কাজ করার অঙ্গীকার করেন। ঐদিন সকালে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের সামনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই অঙ্গীকার করেন জাহিদ। তিনি বলেন, এই সফলতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব অংশীজন এবং সব সাবেক শিক্ষার্থীকে ধন্যবাদ জানাই। যারা ৩৫ বছর ধরে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেও রাকসু নির্বাচন পাননি, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী কাজ করবো। যারা জয়ী হতে পারেননি, তাদের সংখ্যা বেশি। আশা করবো, তারাও আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন। বিজিতদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়েই এই ক্যাম্পাস গড়ে তুলবো। নানা জল্পনাকল্পনা, রাকসু বানচালকারী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
রাবি ভিসির বক্তব্য : রাকসু নির্বাচন শেষে মহান রবের নিকট শুকরিয়া আদায় করে বিজয়ীদের উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। তিনি বলেন, “যারা নির্বাচিত হয়েছে, তাদের মনে রাখতে হবে, পদ উপভোগের বিষয় নয়। এটা আমানত। দলমত নির্বিশেষে সকলের জন্য কাজ করতে হবে। শুক্রবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক পোস্টে তিনি এ বার্তা দেন। রাবি ভিসি বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ! দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু প্রাণ ফিরে পেল। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই জিতে গেছে।” এরপরই নির্বাচিতদের একটি কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “যারা নির্বাচিত হয়েছে, তাদের মনে রাখতে হবে, পদ উপভোগের বিষয় নয়। এটা আমানত। দলমত নির্বিশেষে সকলের জন্য কাজ করতে হবে।”
ছাত্রীদের ৬ হলেই শীর্ষ পদে জয়ী ছাত্রীসংস্থা : রাবি’র হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রীদের ছয়টি হলেই ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে জয় পেয়েছেন ইসলামী ছাত্রীসংস্থার নেত্রীরা। তারা ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) নির্বাচিত মহিলা বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দা হাফছা এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ! ছাত্রীদের ছয়টি হলেই ছাত্রীসংস্থার প্রার্থী ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে বিজয়ী হয়েছেন। সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন। আল্লাহ সবার দায়িত্ব পালনকে সহজ করুন।”
সিনেটে প্রতিনিধি নির্বাচন : রাবি সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে ৫টি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৫৮ জন প্রার্থী। এতে শিবিরের সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট থেকে ৩ জন নির্বাচিত হন। ১২ হাজার ৮৩৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার, ৯ হাজার ৪৬৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, এজিএস পদে পাশাপাশি ৪ হাজার ৬৯০ ভোট পেয়ে সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এসএম সালমান সাব্বির। এদিকে ফাহিম রেজা ৮ হাজার ২০৫ ভোট পয়ে সিনেট সদস্য নির্বাচিত হন এবং ৫ হাজার ৭০৭ ভোট পেয়ে সিনেট সদস্য হন আকিল বিন তালেব।
শোকরানা নামায আদায় : রাকসুতে বিজয়ীদের নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা রাবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে শোকরানা নামায আদায় করে। এতে ইমামতি করেন শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ক্যাম্পাসে আরো উপস্থিত ছিলেন শিবিরের রাবি শাখার সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাসুদ, সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
জামায়াত নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া : রাকসু নির্বাচনে বিজয়ীদের স্বাগত জানান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজশাহী মহানগরী নেতৃবৃন্দ। মহানগরী আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ড. মাওলানা কেরামত আলী ও সেক্রেটারি ইমাজউদ্দীন মন্ডলের নেতৃত্বে জামায়াতের প্রতিনিধি দলটি নির্বাচিতদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান এবং তাদের সাফল্য কামনা করেন। এ সময় মহানগরী সহকারী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাহবুবুল আহসানসহ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।