ববি প্রতিনিধি: কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে চলা আন্দোলন বানচালের উদ্দেশ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছিলো নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ছাড়াও সাংবাদিক সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করতে যেয়েও রেহাই পায়নি তাদের হামলার। গতবছর ৪ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিকাল ৪ টা ৩০ মিনিটে ববির ভিসি গেটের সামনের মহাসড়কে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার মাধ্যমে তাদের অরাজক ঘটনার সূচনা ঘটায়। এসময় আরিফ হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী তাদের হামলার প্রথম শিকার হয়।

মারধরে আহত আরিফ হোসেন ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের (দশম ব্যাচ) রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে নাম উল্লেখ করে ৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও শুধুমাত্র তদন্ত কমিটি গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিচারকার্যের দৃশ্যমান কোনো ফলাফল দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে তদন্ত কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ভুক্তভুগী আহত শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন বলেন, প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দেওয়া হইছিল কিন্তু তারা কাইয়ুম স্যারের সময় ছাত্রলীগ নিয়ে ফোর্স করছিল যাতে বিচার করতে না পারে এরপর কাইয়ুম স্যার পরিবর্তন হলো রাহাত স্যার আসলো তিনি বললো বিচার করবে কিন্তু তিনিও পরিবর্তন হলো আর বিচার হলো না। পরে আমারে মামলা করতে বলছিল কিন্তু আমি চাই ক্যাম্পাস থেকেই ওদের বিচার হোক।

আরিফ হোসেনের ওপর হামলার ঘটনায় ঘটনাস্থলে থাকা শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তুলেছিলো, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হামলার জন্য উস্কে দেন তৎকালীন প্রক্টর ড. মো. আব্দুল কাইয়ুম। তাদের হামলা, মারধরের মুখে সেদিন মহাসড়ক ছেড়ে উঠে আসতে বাধ্য হয়েছিলো শিক্ষার্থীরা।

৪ জুলাইয়ের হামলার ঘটনাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি ছাত্রলীগ বাহিনী। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য ২৯ জুলাই হওয়া ২০ জন শিক্ষার্থীর একটি মিটিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা এ কে আরাফাতের নেতৃত্বে পূণরায় ২০-৩০ জন লাঠি, রড ও পাইপ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। সে হামলায় সুজয় শুভ, সিরাজুল ইসলামসহ ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হলে তাৎক্ষণিক ৯ জনকে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়।

ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিশির আহমেদ সুমন, আইন বিভাগের অমিত হাসান রক্তিম ও মাহামুদুল হাসান তমাল, গণিত বিভাগের মোবাশ্বের রিদম ও আবিদ হাসান, মার্কেটিং বিভাগের শরীফ, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের আবুল খায়ের আরাফাত ও শরিফুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের রাকিবুল হাসান ও সাব্বির হোসেন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের আল সামাদ শান্ত ও খালিদ হাসান রুমি, অর্থনীতি বিভাগের সরোয়ার আহমেদ সাইফ, লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রসেনজিৎ কুমার, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের শওকত হোসেন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের ইরাজ রব্বানী। এছাড়া ব্যবস্থাপনা বিভাগের ফিরোজুল ইসলাম নয়ন ও ইমরান হোসেন নাইম, আইন বিভাগের নাইম উদ্দিন ও শাখাওয়াত হোসেন অনু, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সৈয়দ রুম্মান ইসলাম ও অর্থনীতি বিভাগের মো. রাজিব মণ্ডল। ছাত্রলীগের তখন কমিটি না থাকলেও তারা নিজেদের ছাত্রলীগের পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকায় মাদক ব্যবসা, ডাকাতি সহ নানা অপকর্ম ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকতো। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো বিচারিক ব্যবস্থা না নেওয়াতে অনেকেই এখন ক্যাম্পাসের মুক্তবাতাসেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্লাস পরিক্ষা সহ ছাত্রলীগের দেওয়া প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করছে তারা।

জুলাই হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা শাখার প্রধান সানোয়ার পারভেজ লিটন বাদী হয়ে বন্দর থানায় একটি মামলা করেছিলো। তবে এ মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রদানের জন্য ডাকা হলেও তারা উপস্থিত হন না। ফলে বিচারের কাজ অগ্রসর হচ্ছে না। কয়েকজন সাক্ষীর সাথে কথা বললে বলেছেন সাক্ষী হওয়ার ব্যপারে তারা কিছু জানেন না এবং বেশ কিছু বিষয়ে অন্যদের সাথে মতের মিল না হওয়ার কারনে আদালতে সাক্ষ্য দিতে যান না। তাছাড়া যাদেরকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়েছে তাদের অনেককেই ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে মামলাতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কতৃক বিচারের ব্যর্থতার কারনে বেশ কিছুদিন যাবৎ ছাত্রলীগের আনাগোনা বেড়েছে ক্যাস্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ছাতিম তলা ও কেনানের দোকানের গলির ভিতরে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা ও শলাপরামর্শ করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। শিক্ষার্থীদের ধারনা নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তাদের গোপন কার্যক্রম চলমান। এমনকি কিছুদিন আগে ১৫-২০ জনের একটি শোডাউনের ভিডিও তাদের গ্রুপে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ এ সংগঠনের কার্যক্রমের মদদদাতা হিসাবে নাম উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আলিম সালেহির বিরুদ্ধে। এছাড়াও সহযোগী হিসাবে রয়েছে টিকলি শরীফ, মন্জু সহ কয়েকজন।

মাইলস্টোন ট্রাজেডির ঘটনাকে কেন্দ্র করেও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নাম উল্লেখ করে লিফলেট বিলি, মিলাদের আয়োজন করা ছাড়াও বেশ কিছু দৃশ্যমান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তারা।

বিশ্ববিদ্যলয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে মামলা করা হয়েছিলো সেটি আদালতে না টেকার সম্ভবনা বেশি। তাছাড়া সেটি এখন আদালতের বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেখানে হস্তক্ষেপ করার নেই। আদালত যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটিই হবে। তবে শিক্ষার্থীরা যদি অভিযুক্ত ছাত্রলীগের বিষয়ে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর অভিযোগপত্র দেয় সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে একাডেমিক পানিশমেন্ট নেওয়া হবে। লিখিত অভিযোগপত্র পাওয়া মাত্রই বিচারের কর্যক্রম শুরু করে দ্রুত পানিশমেন্ট নিশ্চিত করবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুনভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রাহাত হোসেন ফয়সাল বলেন, গত প্রক্টরের সময়ে মামলাটি করা হয়েছিলো সেজন্য মামলার বিষয়ে আমার তেমন কিছু জানা নেই তবে ডকুমেন্টসগুলো দেখে এবং যাচাই বাছাইয়ের পর কি করা যাবে তা বলতে পারবো। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের কাছে যদি কোনো অভিযোগ দেওয়া থাকে বা দেওয়া হয় সেটির বিচার করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. তৌফিক আলম বলেন, ১৮ জুলাই অভিযুক্ত ছাত্রলীগ সদস্যদের বহিষ্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলাম সেটা সত্যি তবে দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে আমি কিছুই করতে পারিনি। অসংখ্যা কাজের চাপ, সবগুলো কাজের জন্য লেট হয়ে যাচ্ছে এটা বাস্তব সত্য তবে সদিচ্ছা আছে অবশ্যই দৃশ্যমান করবো। আমরা আলাপ আলোচনা করছি।