স্টাফ রিপোর্টার ও জবি প্রতিনিধি : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেন হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক কোনো বিষয় জড়িত নেই; ‘ত্রিভুজ প্রেমের’ কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। জোবায়েদ হত্যায় এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার তিনজন হলেন- তার ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা (১৯), তার প্রেমিক মো. মাহির রহমান (১৯) ও তার বন্ধু ফারদীন আহম্মেদ আয়লান।
জোবায়েদ হোসেন হত্যার ঘটনায় তার ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা ও তার প্রেমিক মো. মাহির রহমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ তিনজনের নামে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বংশাল থানায় জুবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন মামলাটি দায়ের করেন। তিনজন ছাড়াও অজ্ঞাত আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এদিকে তিন জনের জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করা হয়েছে। মঙ্গলবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বংশাল থানার উপ-পরিদর্শক মো. আশরাফ হোসেন এ আবেদন করেন। এ বিষয় সংশ্লিষ্ট থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা ও উপ-পরিদর্শক তানভীর মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, এ মামলায় তিন আসামি ও একজন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করা হয়েছে।’
জোবায়েদ হত্যার পর তিনজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিতে গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস্) এসএন মো. নজরুল ইসলাম জানান, এই ঘটনাটির সঙ্গে বরগুনার রিফাত হত্যায় তার স্ত্রী মিন্নির জড়িত থাকার ওই ঘটনার সমাঞ্জস্য পাওয়া গেছে। এটা মিন্নির ঘটনার সাথে মোটামুটি সিমিলার। তিনি বলেন, এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নাই, এটা কমপ্লিটলি ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী। এটাকে রাজনৈতিক কালার দেওযার কোন সুযোগ নাই। আমরা এমন কিছু পাইওনি। অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেছেন, পাশাপাশি বাড়িতে ওই মেয়েটি ও তার প্রেমিকের বেড়ে ওঠা ছোটবেলা থেকে। তাদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল দেড় বছরের মত। আর জোবায়েদ মেয়েটিকে তার বাড়িতে যেয়ে পড়াতেন প্রায় এক বছর ধরে। এক পর্যায়ে উভয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। প্রায় একমাস আগে পুরনো প্রেমিক জানতে পারে, জোবায়েদের সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক আছে। বিষয়টি মেনে নিতে না পারায় তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হয়।
পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, মেয়েটি তখন তার পুরনো প্রেমিককে বলে, জোবায়েদকে না সরাতে পারলে তোমার থাকতে পারব না। এমন প্রেক্ষিতেই তারা জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী জোবায়েদের পড়াতে আসার এবং চলে যাওয়ার সময় প্রেমিককে জানিয়ে দেয় মেয়েটি। এরপর ছেলেটি তার বন্ধু আয়লানকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি জানায় এবং তারা দুজনে কেরাণীগঞ্জ থেকে হত্যায় ব্যাহৃত ৫০০ টাকা দিয়ে সুইচ গিয়ার চাকু কিনে আনে। ঘটনার দিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মেয়েটির বাসার নিচে জোবায়েদকে পেয়ে তার প্রেমিক ও আয়লান তাকে ধরে। এবং জোবায়েদের সঙ্গে তার ছাত্রীর প্রেমের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। এ নিয়ে বাকবিত-ার এক পর্যায়ে প্রেমিক তার ব্যাগে থাকা সুইচ গিয়ার চাকু বের করে জোবায়েদের গলার ডান পাশে পোচ দেয়, যাতে তার মৃত্যু হয়। ওই রাতেই মেয়েটিকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে জানিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, পরদিন বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যাকা-ের পুরো ঘটনার সময় মেয়েটি তার বাসার তৃতীয় তলায় দাঁড়িয়ে ছিল জানিয়ে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী বলেন, ছুরিকাঘাতের পর জোবায়েদ সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় গিয়ে মেয়েটিকে দেখতে পায়। তখন তার কাছে জোবায়েদ বলেছিল ‘আমাকে বাঁচাও’। এর জবাবে মেয়েটি বলেছিল, ‘তুমি না সরলে আমি আমার প্রেমিকের হব না’। এ কারণে মেয়েটি কোনো হেল্প করেনাই, এরমধ্যে জোবায়েদ পড়ে যায়। এক প্রশ্নের জাবাবে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেন, মেয়েটি দুইদিকেই সম্পর্ক বজায়ে রাখছে। হয়তো সে ডিসিশান নিতে পারছিল না। ছোট মানুষ, তার আগের প্রেমিক ব্যাপারটা জানার পর হয়ত চাপ দিয়েছে। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর থেকেই মেয়েটি ও তার আগের প্রেমিক মিলে জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মেয়েটি ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর মাহির পুরান ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দীন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বর্ষে পড়ে। জোবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণ সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
গত রোববার জোবায়েদকে ছুরিকাঘাতের পর সিঁড়ির নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত রক্ত পড়েছিল। তিনতলার সিঁড়িতে উপুড় হয়ে পড়েছিল নিথর জোবায়েদ। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র ঘটনাস্থলে জড়ো হন তার সহপাঠী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীসহ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বিচারের দাবিতে তারা বিক্ষোভ করেন তারা। এরপর পুলিশ ওই বাসায় ওই ছাত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারপর রাত ১১টায় ওই ছাত্রীকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে এ হত্যাকা-ের বিচার দাবিতে শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা রাত পৌনে ১১টার দিকে তাঁতীবাজার এলাকায় প্রধান সড়ক অবরোধ করে। প্রায় এক ঘণ্টা রাস্তা আটকে রাখার পর রাত পৌনে ১২টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে বংশাল থানার দিকে রওনা হয়। পরে সেখানে অবস্থান করে টায়ার পুড়িয়ে তারা বিক্ষোভ দেখান। এদিকে এই হত্যাকা-ে সন্দেহভাজন হিসেবে রোববার সন্ধ্যা থেকেই ওই কলেজছাত্রের নাম এবং ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরপর সোমবার সকালে ওই কলেজছাত্রের মা রেখা আহমেদ ছেলেকে নিয়ে গিয়ে বংশাল থানায় হস্তান্তর করে বলে তার স্বজনেরা জানিয়েছেন।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মো. জোবায়েদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করতেন। প্রতিদিনের মত তিনি ১৯ অক্টোবর বিকেল সারে চারটার দিকে বংশাল থানাধীন ৩১নং ওয়ার্ডস্থ নুর বক্স লেন এর ১৫নং হোল্ডিং রৌশান ভিলায় বর্ষাকে পড়ানোর জন্য যান। একই তারিখে সন্ধ্যা প্রায় ৫টা ৪৮ টার সময় ছাত্রী বর্ষা জোবায়েদ হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই সৈকতকে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে জানায় যে, জোবায়েদ স্যার খুন হয়ে গেছে, কে বা কারা জোবায়েদ স্যারকে খুন করে ফেলছে। এ ঘটনার বিষয়টি একই তারিখ রাত অনুমান ৭টার সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. কামরুল হাসান মামলার বাদী জোবায়েদের ভাইকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানান। সৈতক তার শ্যালক শরীফ মোহাম্মদকে সাথে নিয়া মোটরসাইকেল যোগে ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে ঘটনাস্থল রৌশান ভিলায় পৌঁছান।
সৈকত ঘটনাস্থলে গিয়ে তার পরিচিত বড় ভাই অ্যাডভোকেট ইশতিয়াক হোসাইন জিপু আমাকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল রৌশান ভিলা ভবনের নিচতলা থেকে উপরে উঠার সময় আমি ও ইশতিয়াক ভাই সিঁড়ি এবং দেয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পান। ওই ভবনের ৩য় তলার রুমের পূর্ব পার্শ্বে সিঁড়িতে নিয়ে গেলে সিঁড়ির উপর জোবায়েদ এর রক্তাক্ত লাশ উপুড় অবস্থায় দেখতে পান। সুরতহাল প্রস্তুত করার সময় তার গলার ডান পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখতে যায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের কাছ থেকে জেনে এবং আশপাশ এলাকার সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ দেখে উল্লিখিত আসামীসহ অজ্ঞাতনামা বিবাদীরা আমার ভাইকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলার ডান পাশে আঘাত করে হত্যা করেছে মর্মে নিশ্চিত হন।
মৃত্যুর ৪১ ঘন্টা পর বংশাল থানা পুলিশ এই মামলা গ্রহন করে। মামলার বাদি এনায়েত হোসেন সৈকত বলেন, আমাদের পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেই আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। গতকাল আমাদের মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় মামলা করতে একদিন দেড়ি হয়েছে। মামলায় যারা প্রকৃত আসামি আমরা তাদের নাম উল্লেখ করেই মামলা করেছি। আমরা চাই কোন নির্দোষ ব্যক্তি যেন ফেসে না যায় যারা প্রকৃত অপরাধী তারাই শাস্তি পাক। মামলায় যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের সকলকেই পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য পুলিশকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই।