প্রায় ২০ দিন প্রচারণা শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রচারণা শেষ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। আগামীকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ।

ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া নিরাপত্তায় দুই হাজার পুলিশ, ছয় প্লাটুন বিজিবি ও ১২ প্লাটুন র‌্যাব মোতায়ন করেছে প্রশাসন। ক্যাম্পাসের গেটগুলোতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। ভোটগ্রহণের দিন, তার আগের ও পরেরদিন বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে বাসগুলো সময় কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছে। প্রচারণার শেষ দিন ঘিরে পুরো ক্যাম্পাস ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে, জানিয়েছেন নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি। বিভিন্ন বিভাগের সামনে ও আবাসিক হলগুলোতে চলেছে প্রার্থীদের সরাসরি প্রচারণা, পোস্টার ও হ্যান্ডবিল বিতরণ এবং শুভেচ্ছা বিনিময়। এসময় সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস পদপ্রার্থী ফাহিম রেজা বলেন, ‘আমরা মনে করছি রাবিতে এবারে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পড়তে পারে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় ৭০ শতাংশ ভোট কাস্ট হতে পারে। আজকে যে ক্যাম্পাসে উৎসব মুখোর পরিবেশ আমরা দেখতে পারছি শিক্ষার্থীরা এর পূর্ণতা ভোটের মাধ্যমে দিবে ইনশাআল্লাহ।’

শিবির-ছাত্রদলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতার আভাস : সর্বশেষ ১৯৯০ সালের নির্বাচনে প্যানেল হিসেবে ছাত্রদলের একক আধিপত্য দেখা গেলেও এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এককভাবে কাউকে এগিয়ে রাখার সুযোগ থাকছে কম। ভোটকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা গেছে উৎসবের আমেজ। এবারের রাকসু ভোটে আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলিয়ে অন্তত ১১টি প্যানেল অংশ নিচ্ছে। এর বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন প্রার্থীদের আরেকটি অংশ। নির্বাচনে এবার অনেকটা ভিন্ন পরিস্থিতি। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না শীর্ষ তিন পদে কে জয়ী হবেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে রাকসুর শীর্ষ তিন পদসহ অধিকাংশ পদে হবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। তবে সবার নজর ভিপি ও জিএস পদের দিকে। সহ সভাপতি (ভিপি) পদে ছাত্রশিবির মনোনীত মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ও ছাত্রদল সমর্থিত শেখ নূর উদ্দীন আবীরের মধ্যে মূল লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ছাত্রশিবির মনোনীত ফাহিম রেজার সঙ্গে মূল লাড়াই হতে পারে সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দীন আম্মার এবং ছাত্রদলের নাফিউল ইসলাম জীবনের সাথে। সেক্ষেত্রে এ পদে লড়াই হতে পারে ত্রিমুখী। এজিএস পদে শিবিরের সালমান সাব্বিরের সাথে ছাত্রদলের জাহীন বিশ্বাস এষার তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। মঙ্গলবার সরেজমিন ক্যাম্পাস ঘুরে রাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ভোট দেবেন যেভাবে

নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ জানান, একজন প্রার্থীর ভোট দেয়ার জন্য কেন্দ্রে প্রবেশ করে পোলিং অফিসারের থেকে তালিকায় স্বাক্ষর করে ভিন্ন রংয়ের ৬টি ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে হবে। পরে গোপন বুথে যেয়ে তা পুরণ করবেন। এতে প্রথম ব্যালট পেপারে থাকবে সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সাধারণ সম্পাদক, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যালটে থাকবে বিভিন্ন সম্পাদকীয়, পঞ্চম ব্যালটে থাকবে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি ও সবশেষে ষষ্ঠ ব্যালটে থাকবে হল সংসদের প্রার্থীদের তালিকা। ভিন্ন রংয়ের ব্যালট গোপন বুথে পুরণ শেষে ভোটারদের ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে রাখতে হবে। প্রতি ভোটার ভোট দিতে সময় পাবেন ১০ মিনিট করে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত লাইনে অংশগ্রহণকারী ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। কেন্দ্রে ভোট প্রদান করতে ভোট কেন্দ্রে ভোটাররা প্রার্থীর নাম লিখে নিয়ে যেতে পারবেন। প্রার্থীরাও তাদের প্যানেলের তালিকা ভোটারদের দিতে পারবেন। এ বিষয়ে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “আমরা ডাকসু ও জাকসুতে ভোটারদের প্যানেলের তালিকা দেয়ার বিষয়ে অনেক অভিযোগ দেখেছি। এ বিষয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সকল প্রার্থী ও প্যানেল তাদের প্যানেলের তালিকা ভোটারদের দিতে পারবেন। কারণ, আমরা দেখেছি একজন ভোটারের পক্ষে এক সঙ্গে ৪১ জন প্রার্থীর নাম মনে রাখা সম্ভব না। ভোটার যেন কোনো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার না করেন এজন্যই আমরা কাগজ নিয়ে প্রবেশের সুযোগ রাখছি।” ভোট গ্রহণ শেষে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ভোট গণনা করা হবে। এখানে সাংবাদিকরা তাদের সম্প্রচার করতে পারবেন। এ ছাড়াও ভোট গণনার সকল প্রক্রিয়া মিলনায়তনের সামনে বড় স্ক্রিনে দেখানো হবে।

লড়ছে ১১টি প্যানেল

এবার রাকসুতে ছাত্রদল ও শিবির সমর্থিতসহ মোট ১১টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনে ২৩টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৪৭ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে ১৮, জিএস পদে ১৩ এবং এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৬ জন। এছাড়া বাকি ২০টি পদে ২০০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ৫টি পদে ৫৮ জন প্রার্থী এবং হল সংসদ নির্বাচনের ১৫টি পদের বিপরীতে ১৭টি হলে মোট ৫৯৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। রাকসু ও সিনেট নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১১ হাজার ৩০৫ এবং পুরুষ ভোটার ১৭ হাজার ৫৯৬ জন।

৪০০ গজের চৌহদ্দি নির্মাণ

ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কেন্দ্রের ৪০০ গজের একটি চৌহদ্দি করা হবে। এর ভেতরে কোনো প্রার্থী প্রচার চালাতে ও প্রবেশ করতে পারবেন না। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক আকন্দ বলেন, ভোট কেন্দ্রে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে যে ৪০০ গজের চৌহদ্দি নির্মাণ করা হবে এর ভেতর কোনো প্রার্থী প্রবেশ করতে ও প্রচারণা চালাতে পারবেন না। এ ছাড়াও প্রার্থীরা ভোটারদের যে প্রার্থী তালিকা দেবেন সেটা নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হওয়ার পরে না দেয়ায় নিরুৎসাহিত করা হলো।” সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, “আমরা খুবই আশাবাদী এবং নির্বাচনী পরিবেশও অত্যন্ত সুন্দর। ভালো লাগছে এটা দেখে যে প্রতিদ্বন্দিতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই প্রচারণা চালাচ্ছে। টুকটুাক যে দুই একটা ব্যত্যয় ঘটছে না তা-না, তবে বড় কোনো ঘটনা এখনো ঘটেনি। সিন্ডিকেট থেকে যে নির্বাচন কমিশন করে দেয়া হয়েছে সেটা অত্যন্ত শক্তিশালী, তারা এখনো পর্যন্ত ধৈর্য রেখে কাজ করছেন। এটা যারা উপলব্ধি করতে পারছেন না তাঁরা শীঘ্রই বুঝতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন নানারকম অপপ্রচার, খারাপ কথা হজম করেছেন শুধু শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে।”

৩ দিনের বিশেষ নিষেধাজ্ঞা

নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে তিনদিনের বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)। নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ১৫ অক্টোবর রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ১৭ অক্টোবর রাত ১২টা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনে অর্পিত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে জানানো হয়। নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং এর চারপাশের ২০০ গজ এলাকার মধ্যে সব ধরনের মিছিল, মিটিং, সমাবেশ, বিক্ষোভ প্রদর্শন, মাইক ব্যবহার, আতশবাজি বা পটকা ফুটানো নিষিদ্ধ থাকবে। একইসঙ্গে অস্ত্র, লাঠি, ছোরা, বন্দুক, বিস্ফোরকসহ যেকোনো ক্ষতিকারক দ্রব্য বহন ও ব্যবহারও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীরা এ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবেন। আরএমপি জানায়, নির্বাচনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কেউ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।