চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে অস্ত্রধারী স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় অচল হয়ে পড়েছে পুরো ক্যাম্পাস। গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ছিল। ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনিক ভবন ও বিভিন্ন দফতর খোলা থাকলেও পাঠদান কার্যক্রম চালু হয়নি। ফলে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারেই কম। গোলচত্বর, শহীদ মিনার ও অন্যান্য আড্ডাকেন্দ্র ফাঁকা হয়ে পড়েছে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাস ও শাটল ট্রেন যথারীতি চলাচল করছে।

এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক শামীম উদ্দীন খান। তিনি জানান, উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক কামাল উদ্দীনকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, সাবেক ভিপি ও স্থানীয় বিএনপি নেতা এস এম ফজলুল হকসহ ছাত্র প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। অধ্যাপক শামীম আরও বলেন, সংঘর্ষের পর আতঙ্কিত হয়ে অনেক শিক্ষার্থী মেস ও কটেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের পুনরায় মেসে ফেরাতে সিন্ডিকেট সদস্য এস এম ফজলুল হকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উন্মুক্ত রাখা হয়। তিনি জানান, আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে।

অস্ত্রধারী স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গুরুতর আহত তিন শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে দু’জনকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে এবং অপরজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে গতকাল সোমবার প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ (২৪) ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন মিয়া (২৩) বর্তমানে পাঁচলাইশ এলাকার পার্কভিউ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে আছেন। তারা মাথায় গুরুতর আঘাত পান এবং রোববার রাতে অস্ত্রোপচারের পর অবস্থার অবনতি ঘটে। এদিকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলামকে (২৪) রক্তনালীতে গুরুতর আঘাত (ভাস্কুলার ইনজুরি) পাওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর রোববার রাতেই ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।

সিভিল সার্জনের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোববার বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১৪ জন এবং বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে আরও ৩০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। সর্বশেষ সোমবার দুপুর নাগাদ চমেক হাসপাতালে আটজন ও পার্কভিউ হাসপাতালে ছয়জন ভর্তি ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, আহতদের চিকিৎসার বিষয়টি আমরা মনিটরিং করছি। আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুজন লাইফ সাপোর্টে আছেন। একজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বাকিরা আশঙ্কামুক্ত।

এদিকে চবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির চবি শাখার নেতারা এ দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্থানীয়দের হামলায় শিক্ষার্থীরা গুরুতর আহত হলেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এ ঘটনায় চার দফা দাবি তুলে ধরে শিবির। এগুলো হলো- ১. আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নিশ্চিত করা। ২. সব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার ও এলাকা অস্ত্রমুক্ত করা। ৩. ক্যাম্পাসের স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৪. নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বহাল রাখা। চবি শাখা ছাত্রশিবির সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রশাসনের উদাসীনতা এবং পুলিশের নীরব ভূমিকাই হামলাকারীদের সাহস জুগিয়েছে। এ সময় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য ইব্রাহিম হোসেন রনি ও চবি শাখার সেক্রেটারি মোহাম্মদ পারভেজ উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের পরীক্ষা স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার নির্ধারিত সব পরীক্ষা স্থগিত থাকবে। তবে এর পর থেকে পরীক্ষা পূর্বনির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে। অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনায় সামনের কয়েক দিনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী পরীক্ষা যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে।

এ ঘটনায় জারি থাকা ১৪৪ ধারার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আজ ২ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত এ ধারা বহাল থাকবে। সোমবার সন্ধ্যায় হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে রোববার দুপুর ২টা থেকে সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট বাজার এলাকা থেকে পূর্বদিকে রেলগেট পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এ সময়ে ওই এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, মিছিল, গণজমায়েত, বিস্ফোরক দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র বহন এবং পাঁচজনের অধিক মানুষের একত্রিত হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

উল্লেখ্য, শনিবার রাত থেকে শুরু হয়ে রোববার সকাল পর্যন্ত টানা সংঘর্ষে অন্তত ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রোববার দুপুর ২টা থেকে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। হাটহাজারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু কাওছার মোহাম্মদ হোসেন জানিয়েছেন, এ ঘটনায় সোমবার রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি এবং কাউকেও আটক বা গ্রেফতারও করা হয়নি।