নুর আলম নেহাল, রাবি থেকে : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিকেল ৪টায় শেষ হয়। গণনা শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টা থেকে। ৭২ শতাংশ ভোট কাস্টিং হয়েছে বলে জানান প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. সেতাউর রহমান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোট গণনা গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা রাত ৮টায় শুরু হয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে। এই গণনার ফলাফল আজ শুক্রবার সকাল নাগাদ পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
এবারের রাকসু নির্বাচনে মোট ২৮ হাজার ৯০৯ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২০ হাজার ১৮৭ জন। ভোটগ্রহণে গড় উপস্থিতি ছিল ৬৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি দেখা গেছে সৈয়দ আমের আলী হলে, যেখানে ভোট পড়েছে ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে শাহ মখদুম হলে ৭৭ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে ৭৭ দশমিক ৬০ শতাংশ ভোটার অংশগ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে সর্বনি¤œ ভোট পড়েছে রোকেয়া হলে, মাত্র ৫৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। রহমতুন্নেসা হলে ভোট পড়েছে ৬০ দশমিক ৭০ শতাংশ, আর বেগম খালেদা জিয়া হলে ৬১ দশমিক ৪৯ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছেন। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটদানের হারকে প্রশাসন সন্তোষজনক বলে জানিয়েছে। ডিজিটাল স্ক্রিনের মাধ্যমে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন ও শহীদ মিনারে স্থাপিত এলইডি স্ক্রিনে সরাসরি দেখানো হচ্ছে ভোট গণনা। শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন স্ক্রিনের সামনে। এদিকে রাকসু নির্বাচন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা, বিনোদপুর ও মেইন গেটের সামনে জড়ো হন স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের শত শত নেতা-কর্মী। বৃহস্পতিবার দিনভর ছিল দুই দলের নেতাকর্মীদের অবস্থান। জামায়াতের জমায়েতে শিল্পীরা গান গেয়ে শ্রোতাদের উজ্জীবিত রাখেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কমিটির বক্তব্য
রাকসু নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিলেন উপাচার্য সালেহ্ হাসান নকীব। নির্বাচন শেষে সন্ধ্যায় এক ব্রিফিংয়ে এই কমিটিতে থাকা শিক্ষকেরা বলেছেন, ভোটগ্রহণে কোনো অসংগতি চোখে পড়েনি। তবে ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি ছিল। ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে ব্রিফিংয়ে রাকসু নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কমিটির সভাপতি ও অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম এই মন্তব্য করেন। এ সময় এই কমিটির সদস্য সাবেক অধ্যাপক মো. শফিকুল আলম ও সৈয়দ জাবিদ হোসেন তাঁর পাশে ছিলেন। এই কমিটির মোট ৯ জন সদস্য আজ দিনভর রাকসু নির্বাচনের কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেন। ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম বলেন, “বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা, প্রার্থীদের এজেন্ট এবং ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছি, ভোটগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। এ সম্পর্কিত একটা লিখিত প্রতিবেদন রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠানো হয়েছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।”
শিবির-ছাত্রদলের অভিযোগ: এদিকে সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ চললেও দুপুরের পর মৃদু উত্তেজনা দেখা দেয়। দুপুরের পর ভোটকেন্দ্রে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের অভিযোগ তোলেন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ভিপি প্রার্থী। পাশাপাশি উভয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগও তুলেছেন। সোয়া ২টার দিকে রাবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে এক ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তোলেন ছাত্রশিবিরের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। তিনি বলেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ক্যাম্পাসে বসে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রচার করা হচ্ছে ‘জামায়াত অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বা বাইরে থেকে লোক ঢুকাচ্ছে।’ অথচ তিনি নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, ভোটারও নন। তিনি গুজব ছড়িয়ে রাকসুর পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। চিরকুট নিয়ে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে জাহিদ বলেন, “নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল চিরকুট নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে একাধিক স্থানে আমাদের সমর্থকদের প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে। ১০০ গজের ভেতরে কারো যাওয়ার অনুমতি ছিল না, অথচ ঐক্য প্যানেলের অনেকে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং চিরকুট বিতরণ করেছে।” তিনি আরো বলেন, “ছাত্রদল নিয়মের তোয়াক্কা না করে খালেদা জিয়া হল ও হবিবুর রহমান হলের পাশে বুথ স্থাপন করেছে। অথচ বুথ স্থাপনের কোনো অনুমতি ছিল না। বহিরাগত ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির অনেকেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ অনেকে রয়েছেন। এরা কেউ ভোটার বা প্রার্থী নন, তবুও তারা ভোটকেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।” শিবিরের ভিপি প্রার্থী বলেন, গতকাল (বুধবার) নিয়ম ভেঙে দেয়ালে স্লোগান লেখা হয়েছে, কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে নিরব ভূমিকা পালন করছে। যারা নির্বাচনের নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অপর দিকে রাবির শহিদুল্লাহ ভবন ভোট কেন্দ্রে ৩টার দিকে এক প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন অভিযোগ করেন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবির। তিনি বলেন, “দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে ভোটগ্রহণ বন্ধ রেখে পোলিং অফিসার নিজ হাতে সিগনেচার করে ব্যালট পেপারে ভোট দিচ্ছেন এবং তা ব্যালট বক্সে ফেলছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একজন অফিসার ১৫/২০টি ব্যালটে সিগনেচার করতে পারেন, কিন্তু তারা নিজেরাই বিপুল পরিমাণ ব্যালটে ভোট দিচ্ছেন।”
নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষা
নির্বাচন ঘিরে যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভোটকেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্যরাও মাঠে অবস্থান নেন। নির্বাচন কমিশন জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাম্পাসের সংবেদনশীল কেন্দ্রগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে কেন্দ্রীয়ভাবে ১৭টি কেন্দ্রের ফলাফল গণনা শুরু হয়। নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি প্রবেশপথেই পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়। পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ২ হাজার ৩০০ পুলিশ, ছয় প্লাটুন বিজিবি ও ১২ প্লাটুন র্যাব সদস্য মোতায়েন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এবারের রাকসু নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ৯টি অ্যাকাডেমিক ভবনে স্থাপিত ১৭টি ভোটকেন্দ্রে। কেন্দ্রীয় রাকসুর ২৩টি পদে মোট ৩০৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ। সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধির পাঁচটি পদে ৫৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে ১৭টি হল সংসদের ২৫৫টি পদে মোট ৫৫৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মোট ভোটারের ৩৯ দশমিক ১০ শতাংশ নারী, ৬০ দশমিক ৯০ পুরুষ।