রাজধানীর ধানমন্ডির সায়েন্স ল্যাব মোড়ে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবারও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চার ঘন্টার বেশি সময় ধরে এ ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ এবং সহিংসতা এড়াতে বুধ এবং বৃহস্পতিবার ঢাকা সিটি কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দীর্ঘ চার ঘণ্টা পর সংঘর্ষ থেমে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এরপর যানচলাচল শুরু হয় মিরপুর সড়কে।
বিকেলে কলেজটির অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) এফ এম মোবারক হোসাইন সিটি কলেজে ভাঙচুরের অভিযোগ এনে দেশবাসী, পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে বিচার দাবি করেছেন। এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, কয়েক দিন পরপর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষ ঠেকাতে ‘শিগগিরই’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে আলোচনায় বসবে তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকেই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সিটি কলেজের কাছাকাছি চলে আসেন। তখন দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পুলিশকে লাঠিপেটা করে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে দেখা গেছে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সুজন আলী বলেন, সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের মারধর করেছেন। এর জের ধরেই তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের দায়ী করা হচ্ছে। অথচ যারা ওই মারধরে জড়িত, তারা কেউই সিটি কলেজের শিক্ষার্থী নয়। সকালে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা অতর্কিত হামলা করে। তারপর থেকেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের নামপ্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জিসানুল হক বলেন, বেলা ১১টার পর থেকে দুই কলেজের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এসময় সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে পুলিশের চেষ্টার মধ্যে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে সিটি কলেজের নাম ফলক খুলে নিয়ে চলে যায়। পরে আবার উত্তেজনার শুরু হয়। পরে লাঠিপেটা করে ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে দেখা যায় পুলিশকে। পরে আবার সিটি কলেজের সামনে সেখানকার শিক্ষার্থীরা ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে উত্তেজনা গড়ায় বিকাল পর্যন্ত। এদিকে এই সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়ে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান।
পরে সেখান থেকে ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন- আদিব, লিয়ন, ফজলে হাসান, রাজিন, নাজমুস সাকিব ও আহসান শামীম। এর আগে ১৫ এপ্রিল এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুল ইসলাম বেলা একটার দিকে বলেন, দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ছিল, এখন সেটা আর নেই। শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে সে সময় জানান নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুল ইসলাম।
স্থায়ী সমাধান দরকার, পুলিশ: পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম। তিনি বলেন, বারবার এমন ঘটনা কাক্সিক্ষত নয়। এসবের স্থায়ী সমাধান দরকার। ডিসি মাসুদ জানান, তাদের কাছে যে সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে, সেখানে দেখা গেছে যে সায়েন্সল্যাব ওভারব্রিজের কাছাকাছি কিছু সাধারণ পোশাক পরা ছেলে একজনকে ফেলে দেন। এতে তিনি গুরুতর আহত হন এবং তাকে বেল্ট দিয়ে মারধরও করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ঢাকা কলেজের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী এসে সায়েন্সল্যাব এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করেন এবং কিছু অংশ ভেতরে ঢুকেও পড়েন। মাসুদ আলম বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের দুটি টিয়ার শেল ছুঁড়তে হয়েছে। এরপর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে কিছু ভেতরে আর কিছু বাইরে চলে যায়। ঢাকা কলেজের শিক্ষক, এমনকি প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। আমরা সবাই মনে করছি এটা আর নিছক কোনো একদিনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, এটা এখন প্রায় নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। তিনি আরও বলেন, আমাদের পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও ২০-২৫ জন আহত হয়েছে, কারণ আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু এই সংঘাত কতদিন চলবে? আমরা তো চাই না এমন ঘটনায় কেউ প্রাণ হারাক বা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হোক। তাই আমরা চেষ্টা করছি ওপর মহলে যোগাযোগ করে দুই কলেজকে একত্রিত করে এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান করতে। বারবার বলছি এটা আমাদের সবার দায়িত্ব যে যেন ভবিষ্যতে আর এমন কোনো ঘটনা না ঘটে। ওইদিন ডিসি মাসুদ আলম বলেন, কী কারণে সংঘর্ষ হয়েছে তা শিক্ষার্থী এবং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না। ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে পরে তদন্ত করে দেখব আমরা। তবে তারা (শিক্ষার্থীরা) মাঝে মধ্যেই এই কাজ (সংঘর্ষ) করে থাকে।
যা বলেছেন সিটি কলেজ অধ্যক্ষ: ঢাকা সিটি কলেজের স্থাপনায় যখন হামলা হয়, তখন পাশেই পুলিশের ৫০ থেকে ১০০ জন সদস্য দাঁড়িয়ে তা দেখছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এফ এম মোবারক হোসেন। তিনি হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। মোবারক হোসেন বলেন, আজকে আমি দেখেছি, আমাদের কলেজে যখন হামলা হয়, থানা প্রশাসনের লোক, প্রায় ৫০ বা ১০০ জন পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার মনে হয়, তারা যদি সময়মতো পদক্ষেপ নিত, তাহলে আমার কলেজে এ রকমভাবে ভাঙচুর হতো না। বিকেলে ঢাকা সিটি কলেজের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মোবারক হোসেন এ কথা বলেন। সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, অত্র এলাকার জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব থানা-পুলিশকে নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা শিক্ষকদের দায়িত্ব না। এটা প্রশাসনের দায়িত্ব।
আজকের হামলা, ভাঙচুর এবং সংঘর্ষের ঘটনা সম্পর্কে মোবারক হোসেন বলেন, সোমবার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। কে বা কারা তাকে আক্রমণ করেছে। এ নিয়ে ঢাকা কলেজ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছিলেন, তাদের (ঢাকা কলেজ) শিক্ষার্থীরা কোনো গন্ডগোল করবে না, অন্যায় করবে না। সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাও যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় না জড়ায়, সেদিকে শিক্ষকেরা মনোযোগ দেন। হঠাৎ বেলা ১১টার দিকে দেখা গেল, কিছু দুষ্কৃতকারী হামলা চালিয়ে ঢাকা সিটি কলেজের স্থাপনা ভাঙচুর করল, স্থাপনা খুলে নিল। রমজানের আগেও এভাবে ঢাকা সিটি কলেজের স্থাপনার ওপর হামলা করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে মোবারক হোসেন বলেন, এখানে ঢাকা সিটি কলেজে ১২ হাজার শিক্ষার্থী। ঢাকা কলেজে ৭-৮ হাজার শিক্ষার্থী। আইডিয়াল কলেজে ৫-৭ হাজার শিক্ষার্থী। এখানে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর আনাগোনার জায়গা। তারা রাস্তাঘাটে, এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, গল্পগুজব করে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফেসবুক গ্রুপ আছে, সেখানে তারা একে অপরকে কটাক্ষ করে আচরণ করে। ওই বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক-দুইটা মারামারি হয়। শেষ পর্যন্ত এটা বড় আকার ধারণ করে। এটা একেবারে অনিয়ন্ত্রিত ব্যাপার। ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের সঙ্গে মিলে চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে মোবারক হোসেন বলেন, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা আন্তরিক, আমরাও আন্তরিক। এখন আমরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামরা করছি। কিছুদিন আগে প্রশাসন এসব ঘটনায় দু-একজনের ব্যাপারে মামলাও করেছে। সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।’ এদিকে সংঘাত এড়াতে আগামী ২ দিনের জন্য ঢাকা সিটি কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, যেন আবারও কোনো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেজন্য বুধবার ও বৃহস্পতিবার সব ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।