শেষ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে ইসলামি ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। শুরুর দিকে নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ জানালেও পরে শান্তির বার্তা দিয়েছেন বেশিরভাগ পরাজিত প্রার্থী।

ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি পদপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া পোস্টে বলেন, ক্ষুদ্র জীবনে আমি এতদূর আসবো কোনোদিন ভাবিনি। নির্বাচনের আগের রাতে সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ৫ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাই? আমি কোনও সদুত্তর দিতে পারিনি। আমি আসলে কোনোদিনই জানতাম না, নিজেকে কোথায় দেখতে হবে, কোথায় দেখা উচিত। একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রাম এসেছে, নিজেকে রাজপথে সঁপে দিয়েছি। সেই পথ আজ আমাকে এতদূর নিয়ে আসলো। এই নির্বাচনে আমার দিনটা শুরু হয় মিডিয়ার অপপ্রচার দিয়ে। দুপুর থেকেই আমি ভোটে বিভিন্ন যায়গায় একের পর এক সমস্যা খুঁজে পেয়েছি, সারাটা দিন সেসব নিয়ে কথা বলেছি। এই সব অভিযোগের একটা সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে আসবে বলে এখনও আশা রাখি।

মানুষ হিসেবে আমরা কেউ পরিপূর্ণ না। আমি জানি, আপনাদের জন্য যথেষ্ট কাজ করতে পারিনি। সত্যি বলতে জীবন আমাকে সেই সুযোগটুকুও দেয়নি। ভোট দিতে আসার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে মন থেকে ধন্যবাদ জানাই। মাত্র ২০ দিনের ক্যাম্পেইনে চেষ্টা করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রের কাছে ছুটে যেতে। অনেকটা কাছাকাছি গিয়েছি, কিন্তু সবাইকে হয়তো স্পর্শ করতে পারিনি। আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমার যাত্রা এখানেই শেষ নয়, আমার যাত্রা আরও অনেক দীর্ঘ। আমি এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একজন ছাত্রনেতা। কথা দিচ্ছি, আমার নির্বাচনি ইশতেহারে যা কিছু ছিল, তা একজন ছাত্রনেতা হিসেবেই প্রশাসনের কাছ থেকে আদায় করে নিতে যা যা করা দরকার করবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির নতুন শুরুটা আমাদের হাত ধরেই হবে। আমরা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে রাজপথ পাহারা দেবো, নিজেদের সবটুকু দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবো। এর প্রতিফলন আপনারা পরবর্তী ডাকসুতে দেখতে পাবেন। সর্বশেষ তিনি লেখেন, আবিদ আপনাদের কখনও ছেড়ে যাবে না।

ছাত্রদল মনোনীত সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী তানভীর বারী হামিম ফেসবুক পোস্টে বলেন, আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। হাসি-খুশি তবে সংগ্রামী। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ছাত্রদল নেতারা আমাকে সম্মানিত করেছেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছাত্রদল থেকে জিএস প্রার্থী করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাকে যেভাবে প্রকাশ্যে গ্রহণ করেছিলেন, আমার ওপর আস্থা রেখেছেন সেটিও ফলাফলে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি, তারেক রহমান ও ঢাবি শিক্ষার্থীদের কাছে। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক হেরেছি, রাজনৈতিক জীবনে এটাই প্রথম পরাজয়। যদিও এ পরাজয় ভাগ্যের কাছে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির কাছে এবং নিছক সময়ের কাছে। সারা দেশের মানুষের কত দুয়া, নিশ্চয়ই সে দুয়া ব্যর্থ হবে না। তিনি লেখেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার মনের খবর জানতেন, এতোটা সহিহ চিন্তাভাবনা থাকার পরও কেন তাকদিরে এই পরাজয় রেখেছিলেন জানি না। আমি চিরকৃতজ্ঞ এ দলের প্রতিটা নেতাকর্মীর কাছে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শিক অগ্রজদের কাছে, তারা আমার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে তারেক রহমানের কাছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব শিক্ষার্থীর কাছে যারা আমার জয় নিশ্চিত ভেবেছিলেন এবং বিশেষ করে সেসব শিক্ষার্থীর কাছে, যারা মনে করেননি আমি তাদের জন্য যোগ্য!

বাম সমর্থিত প্রতিরোধ পর্ষদের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু এক স্টাটাসে লেখেন, পোস্ট-আইডিয়োলজি বলে কিছু নাই। এগুলো হলো গর্দানকে তলোয়ারের সঙ্গে মিটিংয়ে বসানোর ধান্দা। এই সব বুজরুকির খানা কালকে ব্যালট গোনার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে প্রগতির শক্তি নিয়ে। এই প্রবল প্রতিক্রিয়ার তোড়ে ভেসে গেছে যত পাঁচ-মিশালী শক্তি।

একমাত্র অশিবির ডাকসু ক্যান্ডিডেট হিসেবে জিতলেন হেমা চাকমা, যাবতীয় অপপ্রচারের পরও। তিনি বলেন, এই বাজারে আমি প্রায় ৫ হাজার ভোট পেলাম, অমি পিয়াল, পিনাকী, জিয়া হাসান, কুলদা রায়দের সম্মিলিত অনিঃশেষ আক্রমণের মুখেও। অথচ যাদের পটেনশিয়াল বিজয়ী মনে করা হচ্ছিল সেই বাগছাস, নতুন স্বতন্ত্র জোট এমনকি ছাত্রদল স্ম্যাশড হলো। রিসোর্স, স্ট্র্যাটিজিস্ট সব কিছুর পরও। ভোট রিগিংটা কন্সিডার করেই বলছি। কাজেই এই আধা-খেচড়াগিরি ছাড়েন। আজ যদি বামপন্থিদের ১৮টা হলেই সংগঠন থাকতো তাহলে হয়তো পুরা পরিস্থিতিই অন্য হতো।

তিনি বলেন, গিভ পিপল এ প্রপার অল্টারনেটিভ ভিশান। চ্যালেঞ্জ পিপল। আপনার বিশ্বাসে ফার্ম থাকেন। শত্রুর সামনে চোয়ালবদ্ধ আর মানুষের সামনে বিনয়ী হয়ে লড়তে থাকেন। ত্রিশ বছর ধরে পিছিয়েছি। ১৫ দিনে কী আর পারবো। গুড স্টার্ট। মানুষকে উইন ওভার করা খুবই সম্ভব। অপমান, অত্যাচার আর নিগ্রহ বুক পেতে নেন। যত আঘাত সইতে পারবেন তত লোকের ভরসা হবেন। ভোরের আগেই রাত সবচেয়ে অন্ধকার দেখায়। সর্বশেষ তিনি লেখেন, ৪৮ সালে কমিউনিস্ট দেখলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পুলিশে দিতো। ২০ বছর বাদে তাদের নেতৃত্বে মানুষ বাংলাদেশ বানিয়েছে। কোনও শর্টকাট নাই। আমাদের জীবন দিয়ে লড়ে যেতে হবে। একটু বিশ্রাম নিয়ে নেন।

একই প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী তাসনিম আফরোজ ইমি তার ফেসবুকে লিখেছেন, ডাকসুতে শুভেচ্ছা জানানোর মতো প্রার্থী নির্বাচিত (!) হয়নি। আমি তাদের আমার প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। আমি জুলাইয়ের শহীদ সোহেল রানার মাকে কথা দিয়েছিলাম, তার ছেলের লাশের সন্ধান এনে দেবো ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে। চব্বিশের জুলাইয়ে যারা ঘর ছেড়েছিল তাদের সবাই এখনও ঘরে ফেরে নাই। তাদের সন্ধান চাইবো রাষ্ট্রের কাছে। কেউ সঙ্গে থাকতে চাইলে প্লিজ জানাবেন। অনেক কাজ বাকি।

স্বতন্ত্র ভিপি পদপ্রার্থী শামীম হোসেন বলেন, এই নির্বাচনকালীন সময়টা আমার জীবনে ঝড়ের মতো ছিল। একদিকে প্রচারণায় হিমশিম খেয়েছি। ৯টার মতো হলে নিজে গিয়ে প্রচারণাই করতে পারিনি। আমার ছোট ভাইবোনরা নিজের টাকা খরচ করে প্রচারণা করেছেন তাদের জন্যও কিছু করতে পারিনি। অনেক পত্রিকা এবং ব্যক্তি স্রেফ রাজনৈতিক থ্রেট হিসেবে দেখে আমার নামে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে, আমার পুরো জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। তবুও প্রায় ৪ হাজারের মতো মানুষ আমার মতো অধমকে ভোট দিয়েছেন, যাদের কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবো। আমার দুই বন্ধু যারা সব কিছু উপেক্ষা করে পাশে ছিলেন, তাদের প্রতিও আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ।

ভিপি পদপ্রার্থী জামালুদ্দিন মুহাম্মাদ খালিদ লিখেছেন, বিজয়ীদের অভিনন্দন। আল্লাহ আপনাদের ইনসাফের সঙ্গে কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমার চারটা অসমাপ্ত কাজ ছিল, সেগুলোর দায়িত্ব আপনাদের ওপর অর্পণ করে গেলাম। কাজগুলো হলো

১. হিজাবোফোবিয়ার ওপর করা আমাদের তিন বছরের পরিশ্রম ডকুমেন্টগুলো চেষ্টা করেও কোনও কাজে লাগাতে পারিনি। এটা একটা ঐতিহাসিক দলিলপত্র, আপনারা এটাকে যেভাবেই হোক সর্বোচ্চ কাজে লাগাবেন।

২. গর্ভধারণকালে এটেন্ডেন্সের হার কমানো, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ডে-কেয়ারের ব্যাপারে করা আমাদের দাবিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গঠিত কমিটির সঙ্গে একাধিক সভার মাধ্যমে প্রস্তাবনা আকারে চূড়ান্ত হলেও সিন্ডিকেটে এখনও অনুমোদিত হয়নি। হাজারো নারী শিক্ষার্থী অপেক্ষায় আছে। এটা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন।

৩. রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের ডিজিটালাইজেনশনে বৃত্ত অ্যাপ। অনুমোদন হয়ে গেছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সার্ভারে যুক্ত করা হচ্ছে না। জুলকারনাইন ভাই অনেক আশায় ছিলেন, আমি বের হয়ে আসলে কাজটা হয়ে যাবে। আপনারা তাকে হেল্প করবেন প্লিজ। প্রয়োজনে তার সঙ্গে সমন্বয় করে আরও বেটার কিছু করবেন।

৪. মৈত্রী ও বঙ্গমাতা হলের জন্য বরাদ্দ বাসটা যেন দ্রুত রিসিভ করা হয় এবং অবশ্যই অবশ্যই এ রুটের জন্যই রাখা হয়।

তিনি লেখেন, আমার ওপর যারা বিশ্বাস রেখেছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। যারা ভবিষ্যতের প্রত্যাশা করেছিলেন, তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এক্টিভিজমের ময়দান থেকে দীর্ঘ একটা ছুটি নেওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই আবেগবশত নেওয়া হয়নি। কাছের লোকজনকে আগে থেকে বলে আসছিলাম। আমার নিজেকে ও পরিবারকে সময় দিতে হবে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ কিছু বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা আমি পুরোপুরি বিধ্বস্ত, যেগুলো কাউকে বলতেও পারবো না, বোঝাতেও পারবো না। আমার জন্য দোয়া করবেন।