খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) অচলাবস্থায় একদিকে যেমন সাধারণ ছয় সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ব্যহত হচ্ছে তেমনি আগামী মাস (জুলাই) থেকে শুরু হতে যাওয়া পোস্ট গ্রাজুয়েটদের ভর্তির ব্যাপারেও এখনও কোন বিজ্ঞপ্তি জারি হয়নি। কবে থেকে ফরম বিতরণ, জমা দেয়া, ভর্তি ইত্যাদি সব বিষয়ে জুন মাসেই বিজ্ঞপ্তি জারির কথাছিল। কিন্তু জুন মাসের ২০ তারিখ অতিবাহিত হলেও বিজ্ঞপ্তি জারি না হওয়ায় পোস্ট গ্রাজুয়েটদের সেমিস্টারও বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এদিকে চার মাস অতিবাহিত হলেও এখনো খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। বন্ধ রয়েছে ক্লাস-পরীক্ষা সবই। সাড়ে চারশ’ শিক্ষকের ক্লাস বর্জনের ফলে ছয় সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের অভিভাবকরাও আছেন শঙ্কায়। অনেক পরিবারে এ নিয়ে হতাশা বিরাজ করেছে।

এদিকে মে মাসের বেতন ও ঈদ উল আযহার বোনাস না পাওয়ায় কুয়েটের প্রায় সাড়ে চারশ’ কর্মচারীর পরিবারও দুর্ভোগে পড়েছে। কম বেতনে চাকরি করায় এমন অবস্থা বলে জানান কর্মচারীরা। তা ছাড়া জুন মাস শেষ হওয়ার ফলে কুয়েটের প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকার উন্নয়নকাজের বিল যেমন আটকে যাচ্ছে, তেমনি রাজস্ব খাতে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও অর্থবছরের শেষ হতে চলায় ওই খাতের অর্থও ফেরত যেতে পারে, এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে বহিরাগতদের সংঘর্ষের পর থেকেই অচলাবস্থা চলছে। ওই ঘটনার পর থেকে একাধিকবার সিন্ডিকেট বৈঠক, শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ, হল ত্যাগের নির্দেশসহ নানা কর্মকান্ড হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের হামলার দায়ে তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফার কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন পর্যন্ত পালন করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষা উপদেষ্টাও আসেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে। কিন্তু তাদের দাবিতে তারা অটল থাকেন। শেষ পর্যন্ত ২৫ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ভিসি, প্রো-ভিসি উভয়কেই অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর পরই ওই দিন গভীর রাতে শিক্ষার্থীরা অনশন ভঙ্গ করার পর ১ মে অন্তর্বর্তীকালীন ভিসি নিয়োগ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তিনিও কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি। বরং ৪ মে থেকে শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জন করায় ২২ মে পদত্যাগ করেন অন্তর্বর্তীকালীন ভিসিও। সেই থেকে এখনো অভিভাবকহীন কুয়েট।

কুয়েটের একাধিক সূত্র বলছে, ভিসি না থাকায় একদিকে যেমন বেতন-বোনাস বন্ধ; অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্পের ২৩০ কোটি টাকার কাজেও গতি হারাচ্ছে। ওই সব কাজের জন্য নিয়োজিত ঠিকাদারও জুন মাসের মধ্যে বিল পাবেন কি না সে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের বিল দিতে না পারায় সেসব পরিবারেও দুরাবস্থা চলছে।

সর্বশেষ ঈদের ছুটি শেষে কুয়েট চালু হলে গত ১৫ জুন কুয়েটের কর্তৃপক্ষীয় বৈঠকে সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু উপদেষ্টার সাক্ষাৎ মেলেনি।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুয়েটের একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, কুয়েটের প্রতিনিধি দল শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাতের অনুরোধ জানিয়ে উপদেষ্টার পিএস-এর সাথে সম্প্রতি যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ক্লাস শুরু হয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি আসলেই শিক্ষা উপদেষ্টার সাক্ষাৎ মিলবে এমনটি জানানো হয়েছে। এজন্য এখন ক্লাস শুরুই হতে পারে কুয়েটের অচলাবস্থার একমাত্র পথ বলেও মনে করেন ওই সিনিয়র শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরবেন কি না সে সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও। কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. সাহিদুল ইসলামের মোবাইলে ফোন দিলে তিনি রিসিভ হয়নি। তার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে খুদে বার্তা দিয়েও কোন উত্তর মেলেনি।

কুয়েটের অচলাবস্থায় একদিকে যেমন সাধারণ ছয় সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ব্যহত হচ্ছে তেমনি আগামী মাস (জুলাই) থেকে শুরু হতে যাওয়া পোস্ট গ্রাজুয়েটদের ভর্তির ব্যাপারেও এখনও কোন বিজ্ঞপ্তি জারি হয়নি। কবে থেকে ফরম বিতরণ, জমা দেয়া, ভর্তি ইত্যাদি সব বিষয়ে জুন মাসেই বিজ্ঞপ্তি জারির কথা। কিন্তু জুন মাসের ২০ তারিখ অতিবাহিত হলেও বিজ্ঞপ্তি জারি না হওয়ায় পোস্ট গ্রাজুয়েটদের সেমিস্টারও বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কুয়েটের প্রধান প্রকৌশলী এবিএম মামুনুর রশিদ বলেন, কুয়েটের অচল পরিস্থিতিতে শুধু যে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে তাই নয়, বরং সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ যেমন বন্ধের পথে তেমনি রাজস্ব খাতের অনেক অর্থও অব্যবহৃত থাকছে। বিশেষ করে কুয়েটের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ড. জুলফিকার হোসেন জুয়েল বলেন, নতুন ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া জুলাই মাসের আগে হচ্ছে না এমনটিই মনে হচ্ছে। কেননা সম্প্রতি ভিসি নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজনকে সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়া না হলে আগামী অর্থ বছরের বাজেটের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর্থিক সংকট মিটবে না বলেই মনে হচ্ছে। কারণ সামনে মাত্র ১০-১১ দিন আছে জুন ক্লোজিংয়ের। এটি একটি সংকটজনক সময়।