রাজধানী ঢাকায় ঝুঁকি নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সমীক্ষায় আবারও আতঙ্ক বাড়িয়েছে নগরবাসীর মধ্যে। সর্বশেষ মূল্যায়নে দেখা গেছে, রাজধানীর প্রায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবনই বিভিন্ন মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবনের বড় অংশই নির্মিত হয়েছে নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে, পুরোনো নকশায় বা দুর্বল ভিত্তির ওপর। নগর পরিকল্পনাবিদদের সতর্কবাণী—যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, ঢাকা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

তাদের মতে, যে অঞ্চলে ঢাকা অবস্থিত, সেখানে যেকোনো সময় শক্তিশালী কম্পন দেখা দিতে পারে। তবু ভূমিকম্পের মতো বিস্তৃত দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা এখনো পর্যাপ্ত নয়।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে—উচ্চঝুঁকির জোন-১, মাঝারি ঝুঁকির জোন-২ এবং নিম্নঝুঁকির জোন-৩। আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রকাশিত মানচিত্রে এসব ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত রয়েছে।

মানচিত্র অনুযায়ী দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার অবস্থান জোন-১–এ, যা ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে। ফল্ট লাইন বা প্লেট বাউন্ডারির নিকটবর্তী হওয়ায় এসব এলাকায় কম্পনের প্রবণতা স্বভাবতই বেশি। সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৯টি জেলা, ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদীর কিছু অংশ, পুরো কিশোরগঞ্জ জেলা, কুমিল্লা বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, এবং পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বড় অংশ উচ্চঝুঁকিপূর্ণ। বিপরীতে খুলনা, যশোর, বরিশাল ও পটুয়াখালী জোন-৩–এর আওতায় পড়ে, যেখানে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে অন্তত পাঁচবার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে—যার বেশিরভাগের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায়। এর ফলে ভবিষ্যতেও এসব অঞ্চলে বড় ধরনের কম্পনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এছাড়া ভারতের আসাম ও মেঘালয় সীমান্তসংলগ্ন সিলেট–ময়মনসিংহ অঞ্চলকেও উচ্চঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের চারপাশে ভূমিকম্পের পাঁচটি উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করা আছে। এর একটিকে বলা হয় প্লেট বাউন্ডারি-১, যেটা মিয়ানমার থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত। এছাড়া প্লেট বাউন্ডারি-২ নোয়াখালী থেকে সিলেট এবং প্লেট বাউন্ডারি-৩ সিলেট থেকে ভারতের দিকে চলে গেছে। অন্যদিকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় ডাউকি ফল্ট এবং মধুপুর ফল্ট রয়েছে। এগুলোই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় প্রায় ২১ লাখের মতো ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ ভবন দ্বিতল বা এর চেয়ে কম। এগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কম। কিন্তু ৪ থেকে ৩০ তলা পর্যন্ত বাকি ৬ লাখ ভবন উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। ভূমিকম্পের সময় এগুলো ধসে পড়লে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সংস্কারের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে তোলার কথা বলা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প সবচেয়ে ভয়াবহ এবং অনিশ্চিত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর অন্যতম। এটি প্রতিরোধের ক্ষমতা কারও হাতে নেই। তবে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে ভূমিকম্পের আগাম সংবাদ বা পূর্বাভাস প্রাপ্তির ওপর বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাসের গবেষণায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও বেশকিছু দেশ বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস পেলে প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো যায়। এছাড়া প্রাণহানি কমাতে ভূমিকম্প সহনশীল স্থাপনা নির্মাণসহ নানা প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের ওপর জোর দেওয়া হয়। বিশ্বের অনেক দেশে ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ে স্কুলপর্যায়ে পাঠদান এবং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক।

ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের বিদ্যমান সক্ষমতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ডা. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। শুক্রবারের ভূমিকম্প সেই আতঙ্ক হয়তো আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প যেটার উৎপত্তি ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তাতেই যদি ঢাকা এবং আশপাশের এলাকার স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে এর বড় কম্পন হলে নিঃসন্দেহে বলা যায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। বিল্ডিং কোড অনুসরণ ছাড়াই রাজধানীতে অহরহ ভবন নির্মিত হচ্ছে। সরকারকে এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের এখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনে করে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সচেতনতা প্রয়োজন। কিন্তু ভবন যদি কম্পনের সময় টিকে না থাকে তাহলে পরিস্থিতি জটিল হতে বাধ্য। এজন্য ভবনের ঝুঁকি নির্ধারণ করে সেগুলো সংস্কার করতে হবে।