আন্তর্জাতিক ভূমিকম্প গবেষকদের একটি দল নতুনভাবে একটি সক্রিয় ভূগর্ভস্থ ফাটলরেখা (ফল্টলাইন) আবিষ্কার করেছে। ফাটলরেখাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে—এর মধ্যে এক ভাগে স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে, দ্বিতীয় ভাগে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা, এবং তৃতীয় ভাগে কোনো ভূমিকম্পের ঝুঁকি নেই।

প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফাটলরেখা বাংলাদেশের জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে শুরু হয়ে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। গবেষকদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এটি সর্বোচ্চ ৬ মাত্রার ভূমিকম্প উৎপন্ন করতে পারে।

শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের তথ্যের বরাতে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে একটি গণমাধ্যমকে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আক্তারুল আহসানের নেতৃত্বে এক গবেষণায় নতুন খোঁজ পাওয়া ফাটলরেখা চিহ্নিত হয়েছে। তার সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক ও বাংলাদেশের কয়েকজন গবেষক।

আক্তারুল আহসান বলেন, ‘১৪-১৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায় জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের আয়োজনে ৬ দিন ধরে আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে। সেখানে এ গবেষণার বিস্তারিত ফলাফল তুলে ধরা হবে।’

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের এই উপপরিচালক জানান, তিনি ও তার দল ২০২৪ সালের মার্চে ‘টেকটোনিক জিওমরফলোজি’ পদ্ধতিতে গবেষণা শুরু করেন। সম্প্রতি গবেষণাটি শেষ হয়। এ গবেষণায় ফাটলরেখাটি শনাক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ফাটলরেখাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটার এক ভাগে স্বল্প মাত্রা এবং দ্বিতীয় ভাগ বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। তৃতীয় ভাগে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নেই।’

অবশ্য কোন অংশে ঝুঁকি বেশি, কোথায় কম, তা বিস্তারিতভাবে এখনই প্রকাশ করতে চান না আক্তারুল আহসান। তিনি বলেন, ‘গবেষণাটি নিয়ে একটি নিবন্ধ শিগগিরই বিশ্বখ্যাত একটি জার্নালে প্রকাশিত হবে। সেখানে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।’

বাংলাদেশে ২১ ও ২২ নভেম্বর দুই দিনে চার দফা ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে রিখটার স্কেলে ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এই ভূমিকম্পে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েক দফা ভূমিকম্প হলেও এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ভূমিকম্পে সৃষ্ট কম্পন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।

নতুন শনাক্ত ফাটলের সঙ্গে বড় মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প ও ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের সংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্রহ্মপুত্রের গতিপথের পরিবর্তন এখনো চলছে।

নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, নতুন করে চিহ্নিত হওয়া ফাটলরেখার জন্ম ৫ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে। এ সময়কালকে ভূতত্ত্ববিদ্যার ভাষায় বলা হয় ইউসিন যুগ। সে সময় সক্রিয় থাকা এ ফাটলরেখা ২ কোটি ৩০ লাখ বছর নিষ্ক্রিয় ছিল। নিষ্ক্রিয়তার এ সময়কালকে বলা হয় মায়োসিন যুগ। ৫৬ লাখ বছর আগে ভূত্বকের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেট (যে প্লেটের ওপর উপমহাদেশ ও এর আশপাশের অঞ্চল অবস্থান করছে) ও ইউরেশিয়ান প্লেটের (এশিয়া ও ইউরোপ যে প্লেটের ওপর অবস্থান করছে) ক্রমাগত চাপের ফলে মেঘালয়ের পর্বতমালা মাটির নিচ থেকে উঠে আসার পর এ ফাটলরেখা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে।

পৃথিবীর ভেতরের চাপ বা ধাক্কায় ভূমির আকৃতি ও রূপরেখায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবর্তনকে টেকটোনিক মরফোলজি বলা হয়। নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, ইন্ডিয়ান প্লেট প্রতিবছর ৪৬ মিলিমিটার বা ৪ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এই গতি একেক সময় একেক রকম ছিল। কখনো সোজা উত্তর দিক বরাবর, আবার কখনো উত্তর–পূর্ব দিক বরাবর এ গতি পরিবর্তিত হচ্ছে। কখনো গতিবেগ বেশি ছিল, কখনো কম। ইন্ডিয়ান প্লেটের এই গতির জন্যই ডাউকি ফাটল এবং নতুন আবিষ্কৃত এ ফাটলের জন্ম হয়েছে।

ইন্ডিয়ান প্লেটের এই গতি বেঙ্গল বেসিনের আরও অনেক ফাটলের জন্ম দিয়েছে জানিয়ে গবেষক আক্তারুল আহসান বলেন, ‘এর ভেতর কিছু ফাটল ভূমিকম্প তৈরির সামর্থ্য রাখে, কিছু রাখে না। নতুন শনাক্ত ফাটলের সঙ্গে বড় মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প ও ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের সংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্রহ্মপুত্রের গতিপথের পরিবর্তন এখনো চলছে।’

নতুন শনাক্ত ফাটলরেখার সঙ্গে সরাসরি যে কটি ভূমিকম্পের সম্পর্ক পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ অন্যতম। এটি হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার ২০১০ সালে এক গবেষণা নিবন্ধে বলেছিলেন, সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭। উৎসস্থল ছিল মানিকগঞ্জ। মধুপুর ফাটলরেখায় এই ভূমিকম্প হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ চার্লস স্টুয়ার্ট মিডলম্যাসের গবেষণার বরাত দিয়ে হুমায়ুন আখতার লিখেছেন, ‘এই ভূমিকম্পের কম্পন ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত, ভুটান ও মিয়ানমারের কিছু এলাকায়। তখন অন্তত ৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, যার ৪০ জনই ছিলেন শেরপুরের। ভূমিকম্পটিতে ময়মনসিংহে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।’

১৯২৩ সালে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ এলাকায় আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যেটি ইউএসজিএসের (মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা) আর্থকোয়েক ক্যাটালগে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে। এটির সঙ্গেও নতুন চিহ্নিত হওয়া ফাটলরেখার সম্পর্ক রয়েছে বলে আক্তারুল আহসানের গবেষণায় উঠে এসেছে।

নতুন গবেষণাটিতে ‘মর্ফোলজিক্যাল চেঞ্জ’ বিষয়ে স্যাটেলাইট ম্যাপিং দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতা হলো অনেক ফল্টলাইন বা ফাটলরেখা আছে। গবেষণা করলে এ অঞ্চলে এ রকম আরও ফাটলরেখার সন্ধান মিলবে। ফাটলরেখা থাকা মানেই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হবে, তা বলা যায় না।’