কক্সবাজারের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন রূপরেখা প্রণয়নের লক্ষ্যে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা উপকূলীয় এই অঞ্চলকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ অভিঘাত, বনদস্যুতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষার জন্য অবিলম্বে একটি সমন্বিত ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

Cox's Bazar Community Alliance (CCAD) (সিক্যান্ড)-এর উদ্যোগে আয়োজিত 'Charting the Future: Navigating Challenges and Opportunities in Cox's Bazar' শীর্ষক এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপকূলীয় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সাংসদ ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি কক্সবাজারের ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে রূপ দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

ড. হামিদুর রহমান আজাদ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় ক্ষয় কক্সবাজারজুড়ে এক 'ভয়ংকর বাস্তবতা' তৈরি করেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, জলবায়ুগত অভিঘাতের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ তায়ালার দেওয়া প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন আজ বিলুপ্তির পথে।

তিনি সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, "চকরিয়া এলাকায় একসময় সুন্দরবনের পরেই সবচেয়ে বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ছিল, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী এই বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে দিয়েছে।" তিনি সোনাদিয়া, টেকনাফ, পেকুয়া ও মহেশখালী-কুতুবদিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে বন ধ্বংসের একই চিত্র তুলে ধরেন। আজাদ কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, উপকূলের জনগণকে রক্ষা করতে হলে ধ্বংসপ্রাপ্ত বনগুলো উদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং জনতার আদালতে এই বনদস্যুদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

ড. আজাদ কক্সবাজারকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়মিত ফ্লাইট বাড়ানোর দাবি জানান এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও মহেশখালীর অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি ও জীবিকার ভারসাম্য নষ্ট না হওয়ার বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ সতর্কতা দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, বাকখালী নদী ভরাট করে রানওয়ে সম্প্রসারণের কারণে নদীর মোহনা সংকীর্ণ হচ্ছে, যা মহেশখালীর দিকে ভূমিক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একইভাবে মাতারবাড়িতে বন্দর কার্যক্রমের কারণে কুতুবদিয়া অংশে ভাঙনের আশঙ্কা করেন তিনি।

ড. আজাদ জোরালো দাবি জানান, মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী যে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে—সেই চাকরির অন্তত ৫০% স্থানীয় জনগণের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্য প্রাপ্য ও পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান।

পর্যটন ও ব্লু ইকোনমিকে নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত হিসেবে চিহ্নিত করে বক্তা কক্সবাজারকে দক্ষিণ এশিয়ার ব্লু ইকোনমির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আধুনিক পর্যটন অবকাঠামো, হালাল ট্যুরিজম এবং আন্তর্জাতিক মানের বিশেষায়িত জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের সম্ভাবনার কথা বলেন।

ড. হামিদ আজাদ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আবিষ্কৃত বিরল খনিজ পদার্থ বা 'রেয়ার আর্থস' (যেমন ইলমেনাইট, রুটাইল ও জিরকন)-এর গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এই খনিজগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতির এক বড় চালিকাশক্তি। তিনি এই অমূল্য সম্পদ কাজে লাগাতে আরও গভীর অনুসন্ধান, গবেষণা ও বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন।

রোহিঙ্গা সংকটকে কেবল মানবিক নয়, জাতীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ ও সামাজিক স্থিতিশীলতার এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি সতর্ক করেন যে শিক্ষাবঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী এখন দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের দ্বারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে প্রলুব্ধ হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে।

তিনি এই ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য একটি সমন্বিত সমাধান পেশ করেন। তাঁর মতে, মিয়ানমারে মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে টেকসই সহাবস্থানের জন্য প্রস্তুত করতে হলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য তিনি দেশি ও বিদেশি দাতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বিশেষ শরণার্থী শিক্ষা ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন।

ড আযাদ বলেন, তিনি সরকারে না থাকলেও উপকূলীয় জনগোষ্ঠির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তার বিশেষ প্রচেষ্টার জন্য কুতুবদিয়া রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৩০০০ কোটি টাকা প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের প্রাথমিক পর্বের জন্য পাশ করা হয়েছে। শীগ্রই কাজ শুরু হবে। কুতুবদিয়াতে সী ট্রাক চালু হবে শীগ্রই। আর ফেরি সার্বিস চালুর জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আলোচনার আয়োজক Cox’s Bazar Community Alliance (CCAD)-কে ধন্যবাদ জানিয়ে ড. আজাদ বলেন, "এই আলোচনা কেবল একটি সভা নয়, এটি কক্সবাজারের টেকসই ভবিষ্যতের মানচিত্র প্রণয়নের সূচনা। আমাদের লক্ষ্য— এমন এক উপকূল গঠন, যেখানে উন্নয়ন হবে টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও জনগণকেন্দ্রিক।"

সভার শেষে বক্তারা উপকূলীয় বন পুনরুদ্ধার, স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ, এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।