অবশেষে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে। রবিবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে মেডিসিন বিভাগে এক নারীকে ভর্তির মাধ্যমে প্রথমবারের মত রোগী ভর্তি চালু হল। এই তথ্য নিশ্চিত করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক আক্রামুজ্জামান মিন্টু বলেন, রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে, সোমবার বেলা এগারটায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। রোগী ভর্তির মাধ্যমে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হলো। চিকিৎসায় উন্মোচিত হলো নতুন দ্বার।

জানা গেছে, ২০১১ সালে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে (কুষ্টিয়া শহরে ম্যাটস ক্যাম্পাস) কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় ২০২২ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। সেখানে ছয়তলা একাডেমিক ভবন, চারতলা করে দুটি হোস্টেল, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য তিন ও দুই তলাবিশিষ্ট ডরমিটরি, মসজিদ স্থানান্তর করা হয়। তবে মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল চালু না হওয়ায় ক্যাম্পাস থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লিনিক্যাল ক্লাস করেন। শিক্ষার্থীরা দুটি ভাড়া বাসে যাতায়াত করেন। সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী আছেন।

গত বছরের ১০ জুলাই ও চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি এই হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপে চালুর দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মহাসড়ক অবরোধ করেন কলেজটির শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু না হওয়ায় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, রোগীসহ সাধারণ মানুষের ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে। এ নিয়ে একপর্যায়ে হাসপাতালের পরিচালক আনোয়ারুল কবীর শিক্ষার্থীদের কাছে লিখিত দিয়ে জানান, ২০ দিনের মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিশু ও মেডিসিন বিভাগ চালু করবেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, বর্তমানে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞসহ ৬৮জন চিকিৎসক রয়েছে। নার্স রয়েছে ৩৯জন। এরমধ্যে হাসপাতালের নিয়োগকৃত ১৯জন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে ২০জনকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তার জন্য ৩৬জন আনসার সদস্য রাখা হয়েছে। তৃতীয় ও চর্তুথ শ্রেনীর কর্মচারীও রাখা হয়েছে। গত রবিবার দুপুরে কুমারখালী উপজেলার বাখৈই গ্রামের বাসিন্দা রওশন আরা (৩৩) নামে নারীকে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। এছাড়া শিশু ওয়ার্ডেও রোগী ভর্তি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডে ১৯জন ও শিশু ওয়ার্ডে ২২জন রোগী ভর্তি করা হয়েছে। আপাতত হাসপাতালে এদুটি ওয়ার্ডেই শুধুমাত্র রোগী ভর্তি করা হবে। মেডিসিন বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৫জন ও শিশু বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৫জন রোগী ভর্তি করা হবে। এছাড়া কোন বিভাগে রোগী ভর্তি করা হবে না।

হাসপাতাল সূত্র আরও জানায়, আপাতত হাসপাতালের জরুরি বিভাগ চালু হচ্ছে না। রোগী ভর্তি হতে হলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল থেকে রেফার্ড বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগ থেকে জরুরিভাবে অনুমতি বা কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের পরামর্শে আসা রোগীদের ভর্তি করানো হবে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য অক্সিজেন সাপোর্ট,

কিছু ঔষধ ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থ্যা রাখা হয়েছে। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলোজি) নাসিমুল বারী বাপ্পী বলেন, জেনারেল হাসপাতাল থেকে যদি কোন মেডিসিন ও শিশু বিভাগের রোগীদের রেফার্ড করতে হয় তবে তা কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ৭ তলা ভবনে ৫০০ শয্যার পাশাপাশি ৮৮টি কেবিন, ২৩ শয্যার সিসিইউ, ২০ শয্যার আইসিইউ সেবা আছে। এ ছাড়া জরুরি সেবা দিতে আলাদা আরও ১৩০ শয্যার ব্যবস্থা আছে। এদিকে হাসপাতালের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুনে অন্তত ৯০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনা হয়, যা বর্তমানে হাসপাতালের ভবনের ভেতরে পড়ে আছে। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে অত্যাধুনিক এমআরআই মেশিন, সিটি স্ক্যান, এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন এবং অস্ত্রোপচার কক্ষে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি। ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর হাসপাতাল ভবনের একটি অংশে আংশিক বহির্বিভাগ চালু হয়।

উল্লেখ্য, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৭৫ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর মৌজায় ২০ একর জমিতে নির্মাণ বিভিন্ন সময়ে ৫৩টি প্যাকেজে ৫২ জন ঠিকাদার কাজটি করতে থাকেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও শেষ হয়নি। তখন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত নানা জটিলতায় কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৮ সালে প্রথম দফায় কাজের মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬১১ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়েও কাজ শেষ করতে পারেননি ঠিকাদারেরা। দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

এবার ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮২ কোটি টাকা, যা প্রথমে ধরা ব্যয় থেকে ৪০৭ কোটি টাকা বেশি। ওই মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয়বারের মতো ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ শেষ হয়। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালু হওয়ায় জেলাবাসীর মধ্যে আনন্দ বিরাজ করছে।